Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মাঝেরহাটের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে নিজের পায়ে

কলকাতা পুলিশের ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার হিসেবে খেলা অনুপম বলছেন, ‘‘ভাল কোচ ছিলাম বলেই শরীরের পঙ্গুত্বকে ক্লিন বোল্ড করেছি। আবার ছক্কাও মারব।’’

নবজন্ম: (বাঁ দিকে) হাসপাতালের শয্যায় এ ভাবেই দিন কেটেছে অনুপম সাহুর। (ডান দিকে) আবার নিজের পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। নিজস্ব চিত্র

নবজন্ম: (বাঁ দিকে) হাসপাতালের শয্যায় এ ভাবেই দিন কেটেছে অনুপম সাহুর। (ডান দিকে) আবার নিজের পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০২:২৪
Share: Save:

এক মাস আগেও হাসপাতালের ছোট কেবিনটির জানলা তিনি বন্ধ করে রাখতেন। রাস্তা জুড়ে শারদোৎসবের আলোর রোশনাই, ঢাকের আওয়াজ তাঁর ভাল লাগত না। কেবিনের বিছানায় শুয়ে শুধু স্বপ্ন দেখতেন, আবার হাঁটাচলা করছেন তিনি।

মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনায় কোমরে মারাত্মক চোট পাওয়া কলকাতা পুলিশের কর্মী তথা নগর-দায়রা আদালতের মুখ্য বিচারকের নিরাপত্তারক্ষী অনুপম সাহুর সেই স্বপ্নই সত্যি করলেন এসএসকেএম হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসকেরা। কোমর থেকে পা পর্যন্ত অসাড় হয়ে যাওয়া বছর আটত্রিশের যুবক এখন ফের আগের মতোই হাঁটাচলা শুরু করেছেন। কারও সাহায্য ছাড়াই হাসপাতালের এক ঘর থেকে আর এক ঘরে হেঁটে বেড়ানোর মাঝেই তিনি বললেন, ‘‘স্বপ্ন দেখতাম, আবার হাঁটতে পারব। কিন্তু বাস্তবে যে তা কখনও হবে, ভাবিনি।’’ এসএসকেএমের ফিজিক্যাল মেডিসিনের শিক্ষক চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক বলেন, ‘‘আর কয়েক দিনের মধ্যেই ওঁকে ছুটি দেওয়া হবে। আশা করি মাস তিনেকের মধ্যে ফের স্বাভাবিক ভাবে নিজের কাজে যোগ দিতে পারবেন তিনি।’’

৪ সেপ্টেম্বর বিকেল সওয়া চারটের স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেন না গড়িয়া স্টেশন এলাকার বাসিন্দা অনুপম। ওই যুবক জানান, ঘটনার দিন তারাতলার দিক থেকে তিনি মোমিনপুরের দিকে আসছিলেন, আদালতে যাওয়ার জন্য। গাড়িতে তিনি ও চালক ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। অনুপম বলেন, ‘‘মাঝেরহাট ব্রিজে ওঠার পরেই আচমকা দেখলাম সামনে থেকে সেতুর রাস্তা ভেঙে পড়ছে। মুহূর্তের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে প্রায় ৪০ ফুট নীচে গিয়ে পড়লাম।’’

অনুপম জানান, প্রথম এক মিনিট তিনি বুঝতেই পারেননি কী ঘটে গিয়েছে। এর পরেই টের পান, কোমরে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। একটু নড়াচড়া করতেই দেখেন, পা দু’টি পুরো ঘুরে গেল। গাড়ির চালক তাঁকে টেনে বার করতে চেয়েও

পারেননি। প্রায় ১৫-২০ মিনিট গাড়িতে আটকে থাকার পরে স্থানীয়েরা তাঁকে উদ্ধার করে সেতুর উপরে নিয়ে আসেন। এর পরে কলকাতা পুলিশের অ্যাম্বুল্যান্স চাপিয়ে তাঁকে আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, অনুপমের লাম্বার-১ ভেঙে গিয়েছে। ৬ সেপ্টেম্বর আলিপুরের ওই হাসপাতালেই তাঁর কোমরের অস্ত্রোপচার হয়। শুরু হয় ফিজিয়োথেরাপি। ওই পুলিশকর্মীর স্ত্রী পূরবী বলেন, ‘‘এক মাস ধরে ফিজিয়োথেরাপি চললেও পায়ের দু’টি বুড়ো আঙুল নাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিলেন না অনুপম। আমরাও দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম।’’ তিনি জানান, এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তাঁরা আবেদন করেন। ফের সুস্থ জীবনে ফেরার জন্য তাঁকে সাহায্য করার আর্জি নিয়ে চিঠি দেন অনুপম। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ওই যুবককে এসএসকেএমে ভর্তির ব্যবস্থা করে। সেইমতো ৮ অক্টোবর, মহালয়ার দিন থেকে ফিজিক্যাল মেডিসিনের চারতলার কেবিনের ২ নম্বর শয্যায় রয়েছেন অনুপম।

রাজেশবাবু জানান, ভর্তির পরেই অনুপমকে পরীক্ষা করে বোঝা যায়, শরীরের পাশাপাশি, তিনি মানসিক ভাবেও ভেঙে পড়েছেন। ওই চিকিৎসক বলেন, ‘‘সব কিছু দেখার পরে আমরা প্রথমেই ওঁর কাউন্সেলিং করাই। তাতে তিনি মনের জোর ফিরে পান। এর পরেই আমরা ফিজিয়োথেরাপি, অকুপেশন্যাল থেরাপি-সহ সব রকমের থেরাপি দেওয়ার একটি দল তৈরি করি।’’ তার দ্বারাই ধীরে ধীরে অনুপমের পায়ের মাংসপেশিকে সচল করা হয়। এর পরে ‘গেটার্স’ পরিয়ে ওই যুবককে দাঁড় করিয়ে ওয়াকার দিয়ে অল্প করে হাঁটানো শুরু হয়।

অনুপম জানান, যখন ভর্তি হয়েছিলেন তখন নিজে উঠে বসা তো দূর অস্ত্‌, পাশ ফিরতেও পারতেন না তিনি। কিন্তু গত পনেরো দিন ধরে তিনি নিজেই উঠে বসতে শুরু করেছেন। এর পরে ১৫ নভেম্বর থেকে নিজে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। আর তাই কলকাতা পুলিশের ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার হিসেবে খেলা অনুপম বলছেন, ‘‘ভাল কোচ ছিলাম বলেই শরীরের পঙ্গুত্বকে ক্লিন বোল্ড করেছি। আবার ছক্কাও মারব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE