Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্লাস্টিক বন্ধে মেয়রের ঢাল মানুষের ‘শুভবুদ্ধি’

প্লাস্টিক বর্জনে আইন রয়েছে ১৫ বছর ধরে। অথচ, আজও নর্দমায় প্লাস্টিক বর্জ্য আটকে নিকাশির সমস্যায় ভোগে শহর। খোদ নিকাশি দফতরের মেয়র পারিষদই বলছেন এ কথা। এত দিন পরে প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে নতুন করে ৫০০ টাকা জরিমানা করার কথা বলছে পুরসভা।

বর্জ্য প্লাস্টিকে ভরে গিয়েছে বেলেঘাটার খালপাড়। ছবি: শৌভিক দে।

বর্জ্য প্লাস্টিকে ভরে গিয়েছে বেলেঘাটার খালপাড়। ছবি: শৌভিক দে।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৫২
Share: Save:

প্লাস্টিক বর্জনে আইন রয়েছে ১৫ বছর ধরে। অথচ, আজও নর্দমায় প্লাস্টিক বর্জ্য আটকে নিকাশির সমস্যায় ভোগে শহর। খোদ নিকাশি দফতরের মেয়র পারিষদই বলছেন এ কথা। এত দিন পরে প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে নতুন করে ৫০০ টাকা জরিমানা করার কথা বলছে পুরসভা। কিন্তু সেই জরিমানা নেওয়া হবে কী ভাবে? ঠিক কোন কোন কাজের জন্যই বা হবে সেই জরিমানা? তার জন্য প্রয়োজনীয় নজরদারিই বা চালাবে কে? সে উত্তর অজানা। এ সব নির্দেশ দেওয়ার ভার কলকাতা পুরসভার মেয়র তথা রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কাঁধে। কিন্তু তাঁর ‘দার্শনিক’ মন্তব্য, ‘‘প্লাস্টিকের ব্যবহার রুখতে গেলে শুধু সরকারি নিয়ম দিয়ে হবে না। মানুষের সচেতনতা জরুরি।’’ এতেই আরও বাড়ছে সমস্যা।

হাতে ‘অস্ত্র’ আছে। বিপক্ষ কে, তা-ও অজানা নয়। তবু প্লাস্টিক রুখতে কলকাতা পুরসভা যেন নিধিরাম সর্দার! ফি বছরই বর্ষায় জোরালো বৃষ্টি হয়। জলে ভাসে মহানগরী। তার কারণ হিসেবে উঠে আসে প্লাস্টিকের দৌরাত্ম্যের কথা। তা সামনে এলেই পুরসভা নানাবিধ হুঙ্কার দেয়। যেমন এ বার পুরসভা বলেছে, রাস্তায় প্লাস্টিক ফেলতে দেখলে নাকি ৫০০ টাকা জরিমানা হবে!

পরিবেশকর্মীরা অনেকেই মনে করাচ্ছেন, প্লাস্টিক রুখতে ১৫ বছর আগেই আইন করা হয়েছিল। তা চালু করলেই তো সমস্যা মিটতে পারে। কিন্তু ১৫ বছরে সে নিয়ম কতটা মানা হয়েছে, সে প্রশ্নও রয়েছে। প্রশ্ন জোরদার হচ্ছে গত বিধানসভা ভোটের পর থেকেই। কারণ, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এখন রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রীও। ফলে প্লাস্টিক রোখার জোড়া দায়িত্ব তাঁর কাধেই। ‘‘শুধু কলকাতা নয়, সারা রাজ্যে প্লাস্টিক বন্ধের দায়িত্ব কিন্তু শোভনবাবুর কাঁধেই,’’ মন্তব্য এক পরিবেশকর্মীর।

শহরে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে সমীক্ষা করেছিল পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘টক্সিক লিঙ্ক’। সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, রোজ গড়ে ১২০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় শহরে। নানা জায়গায় নিষিদ্ধ ৪০ মাইক্রনের চেয়ে পাতলা প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগও দেদার বিকোচ্ছে। সেই সব ক্যারিব্যাগ বাজার মারফত চলে আসছে ক্রেতাদের হাতে। সেখান থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে পরিবেশে। পরিবেশবিদদের মতে, তাতে শুধু দূষণই ছড়াচ্ছে না, আটকে যাচ্ছে নালা-নর্দমাও। ভারী বর্ষায় জল বেরোতে পারছে না। টক্সিক লিঙ্কের প্রজেক্ট ম্যানেজার মোনালিসা দত্ত বলেন, ‘‘আমাদের রিপোর্ট কলকাতা পুরসভা ও পরিবেশ দফতরে জমা দেওয়া হয়েছিল। কী ভাবে প্লাস্টিক বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে কথাও হয়েছে।’’

পুরসভা সূত্রের খবর, প্লাস্টিক ছাড়াও যে সভ্যতা টিঁকে থাকতে পারে, বিদেশে ঘুরে তা চাক্ষুষ করেছেন শোভনবাবু নিজেও। কলকাতার উপকণ্ঠে প্রতিবেশী দক্ষিণ দমদম পুরসভার বাঙুর অ্যাভিনিউও প্লাস্টিক বন্ধ করে দেখিয়েছে। তার সুফলও মিলেছে। এক সময়ে বৃষ্টি হলেও বাঙুর অ্যাভিনিউয়ে জল জমা ছিল স্বাভাবিক ছবি। এখন কলকাতা ডুবে গেলেও ওই এলাকা ডোবে না। বাঙুর পারলে কলকাতা পারল না কেন?

পরিবেশকর্মীদের একাংশ বলছে, শুধু কলকাতাই নয়, শহরাঞ্চলের বহু পুরসভার কাছেই বাঙুর আদর্শ হতে পারে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, বছর পনেরো আগে ওই আইন মাত্র প্লাস্টিক রুখতে অভিযানও হয়েছিল। কয়েকটি পুরসভা উদ্যোগীও হয়। কিন্তু কাজ বেশি এগোয়নি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘প্লাস্টিক রুখলে চট শিল্পও বাঁচতে পারত।’’

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বর্তমান কর্তারাও বলছেন, প্লাস্টিক রুখতে কলকাতা পুরসভা বা আশপাশের পুর-কর্তৃপক্ষ, কারও কোনও হুঁশ নেই। ফলে আইন শুধু খাতায়-কলমে রয়ে গিয়েছে। আগে পুরসভা পর্ষদকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান করত। কিন্তু এখন পুরসভা সক্রিয় না হওয়ায় সেই অভিযান বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

তা হলে কি কলকাতায় প্লাস্টিকের এই রমরমা চলতেই থাকবে? কী বলছেন পরিবেশমন্ত্রী-মেয়র?

শোভনবাবুর দাবি, ‘‘৪০ মাইক্রনের চেয়ে পাতলা প্লাস্টিক রুখতে সক্রিয় হয়েছে পুরসভা। প্লাস্টিক রোখার বিষয়টি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।’’ তাঁর মতে, সচেতনতা দরকার।

পরিবেশমন্ত্রী-মেয়রের কথায় অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন পরিবেশকর্মীদের অনেকেই। তাঁরা বলছেন, সচেতনতা প্রসার করেই যদি সমস্যা মিটত, তা হলে এত দিন প্লাস্টিক বন্ধ হয়ে যেত। বস্তুত, গত পনেরো বছর ধরে প্রশাসন বিজ্ঞাপন, পোস্টার লাগিয়ে ‘সচেতন’ করার কাজ করেছে বটে। কিন্তু তাতে কাজ কতটা হয়েছে, সে প্রশ্ন রয়েছে খোদ পরিবেশ দফতরের কর্তাদের মনেই। তাঁদের এক জন নিজের পাড়ায় প্লাস্টিক-বিরোধী প্রচার শুরু করেছিলেন। তাতে পাড়ার এক দোকানি ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘‘এ পাড়ায় আপনার মতো বোকা আর এক জনই রয়েছেন।’’ তা হলে শুধু সচেতনতা প্রচার করে কি ঠেকানো সম্ভব এই প্লাস্টিকের বিপদ? মোনালিসা বলছেন, ‘‘শুধু সচেতনতা দিয়ে হবে না, পুর-প্রশাসনকে আরও কড়া হতে হবে।’’

পুরসভা সূত্রে বলা হচ্ছে, প্লাস্টিক রুখতে কড়া পদক্ষেপ করার আগে নানা দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডেঙ্গির দাপট কিছুটা কমে গেলেই প্লাস্টিক বিরোধী অভিযানে নামার পরিকল্পনা রয়েছে। তা আদৌ কার্যকর হবে কি? প্রশ্নটা রয়েই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mayor garbage plastic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE