Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মনোরোগী তকমা ছেড়ে শিল্পী পরিচয়, সঙ্গী হল রং-তুলি

মগ্ন: রং-তুলি হাতে আঁকতে ব্যস্ত সীতা মাইতি। রবিবার, কুমোরটুলির প্রদর্শনীতে। নিজস্ব চিত্র

মগ্ন: রং-তুলি হাতে আঁকতে ব্যস্ত সীতা মাইতি। রবিবার, কুমোরটুলির প্রদর্শনীতে। নিজস্ব চিত্র

অন্বেষা দত্ত
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৫০
Share: Save:

টুকাই সাধুখাঁ। বয়স ২৫। আদি বাড়ি চেঙ্গাইলে। পরে খিদিরপুরে মায়ের সঙ্গে থাকতেন। সেখান থেকেই তিন বছর ধরে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে নানা কর্মশালায় যোগ দিয়ে হাত পাকিয়েছেন চিনামাটির জিনিস তৈরিতে। তার পরে টান দিয়েছেন তুলিতেও। রবিবার, ‘ওয়ার্ল্ড আর্ট ডে’ উপলক্ষে কুমোরটুলিতে চলছে প্রদর্শনী ‘রং মাটির পাঁচালি’। সেখানে ডাক পেয়েছেন টুকাই আর সীতা মাইতি। সীতা বয়সে টুকাইয়ের চেয়ে কিছুটা বড়। ৩৮-এর এই মহিলারও দু’বছর ধরে ঠিকানা পাভলভ মানসিক হাসপাতাল। স্বামীকে হারিয়েছেন। পরিবারের লোকজনও আর খোঁজ করেন না। নিজের মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়েটাও নাকি ভুলে গিয়েছে মাকে। মেয়েকে দেখাশোনা করেন সীতার ভাই। তিনি সুস্থ হওয়ার পরেও ভাই বা মেয়ে কোনও খোঁজ করেননি বলেই আক্ষেপ সীতার।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মশালার শরিক হয়ে নিজেকে অন্য রকম একটি জীবন উপহার দিতে পেরেছেন সীতা। তুলি হাতে আত্মবিশ্বাসী সীতা নিজেকে এঁকেছেন চালচিত্রের মধ্যে। একই ভাবে টুকাইও খুঁজে নিয়েছেন নিজের অবয়ব। ‘‘বাংলা নতুন বছরের শুরুটা এর চেয়ে আর কত ভাল হতে পারত?’’ প্রশ্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার রত্নাবলী রায়ের। মূলত তাঁদের যত্নেই টুকাই আর সীতার কাছে খুলে গিয়েছে রঙিন পৃথিবী। গত ফেব্রুয়ারি মাসেতেও একটি প্রদর্শনীতে ৪০ জন আবাসিকের সঙ্গে কাজ করেছেন টুকাইরা। সেখানে ওঁদের কাজ দেখে কুমোরটুলিতেও ডাক পড়েছে। এখানে ১২ এপ্রিল থেকে কাজ শুরু করেছিলেন সীতা আর টুকাই। ৪২টি মুখ এঁকেছেন ওঁরা। শুধু দুর্গার মুখ নয়। যেমন যেমন মনে এসেছে, এঁকে গিয়েছেন— পাখি, ফুল, লতাপাতা আরও নানা মোটিফ।

সীতার বাড়ির লোক এর আগে মাঝেমধ্যে দেখা করতে এলেও ইদানীং সে পাট একেবারেই উঠে গিয়েছে। টুকাইও সুস্থ। কিন্তু পরিবার তাঁকে মনে রাখেনি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে জানাচ্ছিলেন ঈপ্সিতা মুখোপাধ্যায়। ওঁদের নিয়ে ভবিষ্যতেও এ ভাবেই এগিয়ে যেতে চায় সংস্থাটি। কাছের স্বজন ফিরিয়ে দিলেও সমাজে ওঁদের অন্তর্ভুক্তি হোক, বলছেন ঈপ্সিতা। নবেন্দু সেনগুপ্ত এবং তাঁর সহকারী অলোক হালদার কাজ শিখিয়েছেন সীতা আর টুকাইকে। এই সব ছবির কাজ করে কেমন লাগছে? ঝকঝকে মুখের সীতা বলে ওঠেন, ‘‘খুব ভাল লাগছে।’’ আগে ভেবেছিলেন কখনও এমনটা পারবেন? সীতা বলেন, ‘‘আগে তো শিখিনি, এমন আরও কাজ করতে চাই।’’ ছবি আঁকা ছাড়াও সীতা বেকিং করেন অনায়াসে। ভালবাসেন গান শুনতেও।

মগ্ন: রং-তুলি হাতে আঁকতে ব্যস্ত টুকাই। রবিবার, কুমোরটুলির প্রদর্শনীতে। নিজস্ব চিত্র

মায়ের কথা খুব মনে পড়ে টুকাইয়ের। কিন্তু তাঁর মায়ের খোঁজ এখনও পাননি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা। টুকাই আশায় দিন গোনেন, যদি এক বার দেখতে পান মায়ের মুখটা। টুকাই বলেন, ‘‘নিজের ছবি এঁকেছি। আরও অনেক কিছু করেছি। যে কোনও কাজ করতে পেলেই আমি খুশি।’’ পাভলভ থেকে বেরোনোর সুযোগ খুব কম হয়। তাই এমন সুযোগ পেলে লাফিয়ে পড়েন ২৫-এর যুবকটি। বলেন, ‘‘সময়টা তো কেটে যায়!’’

যে সময়টা ভুলে গিয়েছে টুকাইদের, নিজেদের ছবি এঁকে সেটাই ফিরে পেতে চাইছেন ওঁরা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pavlov Mental Hospital Painting Sculpting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE