ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন অরুণবাবু এবং আরতিদেবী। রবিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
আবাসনের মিটার বক্স থেকে তখন আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। ছ’তলা বহুতলের পাঁচতলা পর্যন্ত কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। বহুতলের ভিতরে তৈরি হয়েছে দমবন্ধ পরিস্থিতি। আতঙ্কে আবাসনের সব বাসিন্দারা যখন নীচে নেমে গিয়েছেন, তখনও আবাসনের পাঁচতলায় আটকে রইলেন ৯৪ বছরের অরুণ দত্ত এবং তাঁর স্ত্রী, ৮৪ বছরের আরতি দত্ত। রবিবার সকালের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আরতি দেবী বলেন, ‘‘আমি না থাকলে উনি হয়তো দমবন্ধ হয়ে ঘরের মধ্যেই মারা যেতেন।’’
কালীঘাট মেট্রো স্টেশন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, লেক মলের রাস্তায় অবস্থিত ওই আবাসন ‘দি অ্যাভিনিউ কোর্ট’। আবাসনের একতলার ভিতরের দিকের অংশে রয়েছে গ্যারাজ। ফুটপাত লাগোয়া অংশে একটি পানশালার পাশাপাশি কিছু দোকান রয়েছে। আবাসনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একাধিক সংস্থার অফিস। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ আবাসনের মিটার বক্স থেকে প্রথমে ধোঁয়া বেরোতে দেখেন এক নিরাপত্তারক্ষী। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বিকট শব্দে মিটার বক্সে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকলে ওই নিরাপত্তারক্ষী চিৎকার করে বাসিন্দাদের দ্রুত নীচে নেমে আসতে বলেন। ওই আবাসনে এখন ছ’টি পরিবার থাকে। বিপদের আভাস পেয়ে তাঁদের বেশি ভাগই নীচে নামলেও আটকে পড়েন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসক অরুণবাবু এবং তাঁর স্ত্রী।
গত ফেব্রুয়ারিতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে অরুণবাবুর কোমরের নীচের অংশ দুর্বল হয়ে গিয়েছে। ভাল করে হাঁটাচলা করতে পারেন না তিনি। স্ত্রী আরতিদেবীরও সম্প্রতি হৃৎপিণ্ডে পেসমেকার বসেছে। অগ্নিকাণ্ডের জেরে আবাসনের লিফট কাজ করছিল না। কী ভাবে নামবেন, তা বুঝতে না পেরে দরজার পাশে একটি টেবিলের উপর বসে পড়েন অরুণবাবু। আরতিদেবী তাঁকে কোনও ভাবে সিঁড়ির রেলিং ধরে নামতে বলেন। স্ত্রী সাহস দিলে তাঁর সাহায্যে কোনও রকমে রেলিং ধরে নামতে শুরু করেন অরুণবাবু। এ ভাবে তিনতলা পর্যন্ত নামার পরে প্রচণ্ড ধোঁয়ায় চোখ-মুখ জ্বলতে থাকে দু’জনেরই। তার উপরে অভিযোগ, সিঁড়ির মুখে পানশালা কর্তৃপক্ষ কিছু সামগ্রী মজুত করে রাখায় নামতে অসুবিধা হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে অন্য বাসিন্দাদের তৎপরতায় উদ্ধার করা হয় দু’জনকে। তত ক্ষণে মিটার বক্সের সামনেই থাকা অরুণবাবুর গাড়ির একাংশ পুড়ে গিয়েছে। গ্যারাজের সিলিং বরাবর পাইপ গলে গিয়েছে আগুনের তাপে। আরতিদেবী বলেন, ‘‘কিছুটা কোলে তুলে, কিছুটা ধরে সকলে আমাদের নীচে নামালেন। একতলার পরে উনি তো বসেই পড়লেন। বাকি সিঁড়িগুলো ঘষটে ঘষটে নীচে নামলেন।’’
অঘটন: সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছে ওই আবাসনের মিটার বক্স। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
দমকলের দু’টি ইঞ্জিনের চেষ্টায় আগুন নেভানো হয়। এ দিনের ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন বাসিন্দারা। অভিযোগ, মিটার বক্স থেকে পাঁচ মিটার দূরত্বে সাতটি গ্যাসের সিলিন্ডার মজুত করে রেখেছিলেন পানশালা কর্তৃপক্ষ। আগুন সেখানে ছড়িয়ে পড়লে কী হত, তা ভেবে শিউরে উঠছেন বাসিন্দারা। ফেব্রুয়ারি মাসে মিটার বক্সে আগুন লাগার পরে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে আবাসনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা মেরামত করা হয়েছিল। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে ফের মিটার বক্সে আগুন লাগার কোনও ব্যাখ্যা নেই আবাসিকদের কাছে। প্রাথমিক ভাবে দমকলের অনুমান, শর্ট সার্কিট থেকেই আগুন লাগে। পানশালা কর্তৃপক্ষ অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
টালিগঞ্জ থানা সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই ওই আবাসনের অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য সিইএসসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য আলাদা করে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া রয়েছে কি না, দেখতে বলা হয়েছে তাও। স্থানীয় বিজেপি কাউন্সিলর সুব্রত ঘোষ বলেন, ‘‘বারবার ওই আবাসনে কেন আগুন লাগছে, তা নিয়ে কড়া পদক্ষেপ চেয়ে মেয়র এবং প্রশাসনকে চিঠি দেব।’’ দমকলের ডিজি জগমোহন বলেন, ‘‘বাসিন্দাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy