পাড়ার মোড়ে ব্যস্ত চায়ের দোকান। কাজ-আড্ডার ভিড়। গা ঘেঁষেই সাঁ সাঁ অটো, তাতেই ধাক্কা দিয়ে রিকশা।
কে বলবে গলির ভাঁজে ভাঁজে ইতিহাস এখানেও!
পাঁচতলা বহুতলে আকাশ ঢেকেছে এই এলাকারও। পায়ে পায়ে বড় বড় দোকান। রীতিমতো জমজমাট রাস্তা। বোঝাই দায় এক কালে টিনের চাল, কয়লার উনুনের এই সব এলাকায় যাতায়াতের জন্য যানবাহন পেতে রীতিমতো সমস্যায় পড়তেন বাসিন্দারা! ’৪৭-এর পরপর এ শহরে চলে আসা ও-পার বাংলার বহু মানুষ তিলে তিলে এই অঞ্চলে নতুন করে গড়তে শুরু করেন জীবন। গত শতকের চারের দশকের শেষ দিক থেকে এ ভাবেই বেড়ে ওঠা এই বিজয়গড় কলোনি ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নিয়েছে কলকাতা-৩২ হিসেবে। তার মাঝে জবরদখল করা এই সব এলাকা ঘিরে হয়েছে কত আন্দোলন, রাজনীতি। ’৫১ সালে ময়দানে উদ্বাস্তুদের সমাবেশ, ’৫৩ সালের এপ্রিলে ঐতিহাসিক বিধানসভা অভিযান পরিণতি পেয়েছে ১৯৫৪-এর সরকারি সিদ্ধান্তে। স্থায়ী অস্তিত্বের আশ্বাস পায় বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনি অঞ্চল।
পশ্চিমবঙ্গের প্রথম উদ্বাস্তু কলোনি বলে পরিচিত বিজয়গড়ে বছর বছর এখন তরতরিয়ে চড়ছে জমি, ফ্ল্যাটের দাম। একই ভাবে রূপ বদলেছে শহরের নানা প্রান্তে বেড়ে ওঠা বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনি অঞ্চলেরই।
নতুন আসা কারও চোখে ধরা পড়তেই পারে, শহরের আশপাশের এই সব এলাকায় সরু রাস্তা, গায়ে গায়ে বেড়ে ওঠা বাড়ির এই পাড়াগুলোর চেহারার সঙ্গে অনেক ফারাক সাহেব-বাবুদের কলকাতার। কিন্তু ততটুকুই। বিশ্বায়নের জোয়ারে দমদমের অমরপল্লি হোক বা দক্ষিণের নেতাজিনগর, আজাদগড়— সব উদ্বাস্তু কলোনির অদূরেই এখন ঝাঁ চকচকে শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্স। বাকি শহরের সঙ্গে ফারাক ঘুচেছে অনেকটাই। উন্নয়ন বলে দেয়, ঝাপসা হচ্ছে দেশ ভাগের ধাক্কা।
সঙ্গে কি তবে ঝাপসা হচ্ছে ইতিহাসও?
সাতের দশকে বিজয়গড় চত্বরে বড় হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা পিঙ্কা নাগ। বাড়ির বড়রা ছিলেন কলোনি গঠনের সঙ্গে যুক্ত। ছোটবেলা থেকেই কলোনির নানা কাজে থেকেছেন তিনিও। তবে জানান, বিজয়গড় কলোনির যে কমিটি এক কালে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে নানা উন্নয়নে, তার এখন প্রায় অস্তিত্বই নেই। তিনি বলেন, ‘‘কলোনি কমিটির পুজোটা এখনও হয় শুধু। স্থানীয় পাঠাগারে যে কমিটি অফিস ছিল, তা আজ প্রায় ১০-১২ বছর হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’ আর রয়েছে কলোনি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ভূপেন নাগের নামে একটা পার্ক। অথচ এই পাড়ারই ঘরে ঘরে এক কালে বেড়ে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গের কলোনি আন্দোলন।
পাঁচ-ছয়ের দশকে নাগেরবাজার চত্বরে দমদমের ভগবতী কলোনিতে বড় হওয়া কণিকা সেনগুপ্তেরও আক্ষেপ, এখন আর অস্তিত্বই নেই কলোনি কমিটির। এলাকার উন্নতির সঙ্গে মুছে যাবে না তো অঞ্চলের ইতিহাস? অাশঙ্কা তাঁর। কণিকাদেবী মনে করান, এক সময়ে বাকি কলকাতায় বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুতের লাইন গেলেও আলো-পাখার সুখ ছিল না কলোনির বাসিন্দাদের। ‘‘তবু সে কষ্টের মধ্যেই গান-বাজনা, লেখাপড়া নিয়ে মেতে আনন্দে বড় হয়েছি আমরা। কত ভাল ভাল ছাত্র তখন আমাদের পাড়ায়। কত অনুষ্ঠান হতো কলোনি কমিটির উৎসাহে।’’
সংস্কৃতি চর্চায় বরাবরই বিশেষ জোর দেওয়া হতো সব উদ্বাস্তু কলোনিতে। গানবাজনা-নাটক শুধু শিল্প নয় তখন, সংস্কৃতি চর্চা ছিল নতুন ভাবে গুছিয়ে নেওয়ার শক্তি। ফলে প্রায় সব কলোনিতেই একসঙ্গে পুজো, জলসা ছিল রীতি। এমনই সব কথা মনে করালেন দেশ ভাগ এবং উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে চর্চায় যুক্ত প্রাবন্ধিক ও গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘সময়ের নিয়মে এখন সে প্রয়োজন কমেছে। তাই আগের মতো নিয়ম করে কলোনির অনুষ্ঠান হয়তো এখন আর দেখা যায় না। আগে তো এক-একটা উদ্বাস্তু কলোনি ছিল বৃহত্তর সমাজের মধ্যে আর একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ সমাজ।’’
সেই সব ‘সমাজে’ও দেশভাগের কষ্ট ভুলে বছর বছর পালন হতো স্বাধীনতা দিবস। এখনও হয়। আধুনিক সুবিধায় দিন দিন উন্নত হওয়া সে সব অঞ্চলে এখন অনেকেই জানেন না, দু’প্রজন্ম আগে কতটা লড়াইয়ে গড়ে উঠেছে সেই পাড়া। আগের প্রজন্মেরাও স্বস্তিতে যে, ছোটদের জানাতে হয় না সেই সব ভয়ের দিনের কথা। এত বছরে অবশেষে খানিকটা থিতু হয়েছে পরিবার। সময়ের নিয়মেই তাই কলোনির পরিচয় মিশে যেতে শুরু করেছে বাকি শহরের সঙ্গে।
তবু বহুতল-গাড়ির ফাঁকে উঁকি দেওয়া অলিগলি-পুকুর-পার্ক-ভগ্নপ্রায় মণ্ডপ-বন্ধ হওয়া স্কুল মনে করায় এই দিনটা শুধু স্বাধীনতার নয়। সত্তর বছর হল দেশ ভাগেরও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy