এই বাড়িতেই খুন হয়েছেন চিকিৎসক চান্দ্রেয়ী দাসচৌধুরী।-নিজস্ব চিত্র।
এসএসকেএম হাসপাতালে তখন সবে আনা হয়েছে পেশায় চিকিৎসক চান্দ্রেয়ী দাসচৌধুরীকে। পরিবারের লোকজনের দাবি, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন, চান্দ্রেয়ী মারা গিয়েছেন। পরিবারের লোকজনকে সে কথা তিনি জানিয়ে দেন। কিন্তু, দেহ পরীক্ষা করতে গিয়েই তাঁর সন্দেহ হয়। শরীরে এত আঘাতের চিহ্ন কেন?
সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্থানীয় ভবানীপুর থানায় বিষয়টি জানান। মৃতের বাড়ি রবীন্দ্র সরোবর থানা এলাকায় হওয়ায় ভবানীপুর পুলিশ বিষয়টি তাদের জানিয়ে দেয়। তার পরেই পুলিশ বিষয়টি নিয়ে যেন হাত ধুয়ে ফেলে। স্বতপ্রণোদিত ভাবে তদন্ত তো দূরের কথা, এ বিষয়ে এক ফোঁটাও পদক্ষেপ করেনি তারা। সেটা ২২ মে-র ঘটনা। তার প্রায় দু’মাস পর যখন ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা গেল চান্দ্রেয়ীকে খুন করা হয়েছে, তখন সেই পুলিশের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। কেন সেই সময় তারা হাত গুটিয়ে বসেছিল! পুলিশেরই একটা অংশ বলছে, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের এক জন চিকিৎসক যখন মৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই সময়েই কেন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি?
গত ১২ জুলাই চান্দ্রেয়ীর ময়নাতদন্তের সম্পূর্ণ রিপোর্ট আসে। সেই রিপোর্টে তাঁকে গলা টিপে মারা এবং মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্নের কথা বলা হয়। প্রাক্তন এক পুলিশ কর্তার মতে, অনেক সময় বিষ প্রয়োগে মৃত্যুর ক্ষেত্রে তা প্রমাণের জন্য ভিসেরা রিপোর্টের অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু চান্দ্রেয়ীর তো মৃত্যু হয় গলা টিপে। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টেই তো সেটা বোঝা যায়। সেখানেই তাঁর প্রশ্ন, ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টকে কেন গুরুত্ব দিয়ে দেখল না পুলিশ? কেন তারা পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল?
পুলিশের একটা অংশের মতে, এই গাফিলতিগুলো যদি না থাকত তবে আজ খুনের প্রায় দু’মাস পর তাদের তদন্তের কাজে হাতড়ে বেড়াতে হত না। চান্দ্রেয়ীর মৃত্যুর পরেই ঘটনাস্থল থেকে অনেক কিছুই সংগ্রহ করার সম্ভাবনা থাকত। পাওয়া যেত ঘটনার তথ্যপ্রমাণও। অপারাধ গবেষকদের একটা অংশ বলছেন, খুনি অনেক সময়েই ঘটনাস্থলে কোনও না কোনও প্রমাণ রেখে যায়। যা দেখে তদন্তকারীদের অপরাধী ধরার ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে ঘটনার পর অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে কোনও তথ্যপ্রমাণই সংগ্রহ করতে পারেনি পুলিশ।
এ ক্ষেত্রে এই দু’মাসের মধ্যে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের যথেষ্ট সময় পেয়েছে অপরাধীরা। এমনকি তদন্তকারীদের কাছে ধরা পড়ে গেলেও তাঁদের প্রশ্নের মুখে কী কী ঘটনাক্রম সাজানো যাবে, তার প্রস্তুতি নিতেও তারা যথেষ্ট সময় পেয়েছে। যদি পুলিশ ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তৎপর হত, তা হলে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে চান্দ্রেয়ীদের বাড়ির সামনের সিসিটিভি ফুটেজও সংরক্ষণ করতে পারত। যা কাজে লাগত তদন্তের। বোঝা যেত, ঘটনার সময় কে বা কারা ওই বাড়িতে যাতায়াত করেছিল। কিন্তু, সে গুড়েও বালি। কারণ, বিশেষ কোনও প্রয়োজন ছাড়া পুলিশ ২৫ দিনের বেশি সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ করে না। এ ক্ষেত্রে ঘটনার পর ৫০ দিন অতিক্রান্ত। কাজেই সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়ার প্রায় কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই জানিয়েছেন তদন্তকারীদের একাংশ। সুতরাং, ঘটনার দিনের কোনও ডিজিটাল প্রমাণ আর পুলিশের হাতে নেই বলেই মনে করছেন কেউ কেউ। খুনির সন্ধান পেতে পুলিশের হাতে তাই আপাতত কী রইল? প্রাক্তন এক পুলিশ কর্তার মতে, এত রকম গাফিলতির ফলে খুনের জবরদস্ত কোনও প্রমাণ তদন্তকারীদের পক্ষে পাওয়া এই মুহূর্তে কার্যত অসম্ভব।
আরও পড়ুন: চিকিৎসক খুনে মিলছে না সূত্র
তা হলে বাকি থাকল কী? তদন্তকারীদের একটা অংশের মতে, মৃতের আত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করেই বিষয়টি জানা সম্ভব। ইতিমধ্যেই তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন চান্দ্রেয়ীর মা, ভাই এবং মামাকে। কিন্তু, কোনও সদুত্তর মেলেনি সেই জিজ্ঞাসাবাদে। তাঁরা পুলিশকে খুব বেশি তথ্য দিয়ে সাহায্য করেননি বলেই জানা গিয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের বক্তব্যেই অসঙ্গতি রয়েছে বলে তদন্তকারীদের একটা অংশ জানিয়েছেন। চান্দ্রেয়ীর বিষয়ে অনেক কিছুই গোপন করছেন তাঁরা।
চান্দ্রেয়ীর মৃত্যুর কয়েক দিন পরে ছেলের সঙ্গে দিঘায় গিয়ে ছিলেন তাঁর মা। সে বিষয়ে প্রথমে কিছু পুলিশকে বলতে চাননি চান্দ্রেয়ীর পরিবারের লোকজন। কেন তারা তথ্য গোপন করছিলেন, তা-ও বুঝতে পারছেন না তদন্তকারীরা। তদন্তকারীদের অনুমান, চান্দ্রেয়ীর মৃত্যুর নেপথ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ থাকতে পারে। পরিবারের সদস্যরা মুখ না খোলায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাই এ বার ওই পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং সম্পত্তির বিষয়েও খোঁজ খবর শুরু করেছে পুলিশ।
সব মিলিয়ে গোটা ঘটনায় পুলিশের চূড়ান্ত গাফিলতিই খুঁজে পাচ্ছেন পুলিশের এক প্রাক্তন কর্তা। তাঁ মতে, এর পর আদালতে গিয়ে কী বলবে পুলিশ? অপরাধীরা কি আর তদন্তকারীদের অপেক্ষায় বসে তাকবে এত দিন ধরে। তারা তাদের কাজ ইতিমধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy