মুখোপাধ্যায় পরিবার আয়োজিত রক্তদান শিবির। নিজস্ব চিত্র
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত একরত্তি ছেলেটার জন্য রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে হামেশাই সমস্যায় পড়তেন পরিজনেরা। সেই সময়েই খুব কাছ থেকে দেখতেন, রক্তের জন্য কী ভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে নিজেরাই রক্তদান শিবির করতে উদ্যোগী হয় সোদপুরের একটি পরিবার। এক-দুই বছর নয়, টানা ২৭ বছর ধরে চলছে সেই শিবির। যেখানে রক্ত দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উড়ে আসেন আত্মীয়, পরিচিতেরা।
গত রবিবারই সোদপুরের উত্তরপল্লিতে মুখোপাধ্যায় বাড়ির দু’টি গ্যারাজে এবং উঠোনে ম্যারাপ বেঁধে আয়োজন হয়েছিল রক্তদান শিবিরের। গ্রীষ্ম এবং শীত— বছরে এই দু’বার ওই রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেন মুখোপাধ্যায়েরা। প্রধান উদ্যোক্তা পরিবারের ছোট ছেলে মুরারিবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘২৭ বছর আগের উৎকণ্ঠার দিনগুলির স্মৃতি আজও টাটকা। এক বোতল রক্ত জোগাড় করতে নাজেহাল হয়ে যেতাম।’’ তিনি জানান, তাঁর দাদা গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে শৌভিকের দেড় বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। সেই সময় ব্লাড ব্যাঙ্কে শৌভিকের জন্য ‘ও’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতেন মুরারিবাবুরা।
তাঁরা জানান, শৌভিক এখন ৩১ বছর বয়সি এক আইনজীবী। এখনও তাঁর নির্ধারিত সময় অন্তর রক্তের প্রয়োজন হয়। তবে শুধুমাত্র দু’দশকের বেশি সময় ধরে পারিবারিক এই রক্তদান শিবির শৌভিককে তো বটেই,তার বাইরেও আরও অনেককে রক্ত সঙ্কটের সম্মুখীন হওয়া থেকে রেহাই দিয়েছে।
মুরারিবাবুরা জানান, আশির দশকের শেষের সেই সময়টায় ছোট্ট ভাইপোটির জন্য রক্তের খোঁজে তাঁরা হন্যে হয়ে ঘুরতেন বিভিন্ন ব্লা়ড ব্যাঙ্কে। কখনও রক্ত পেতেন, কখনও আবার পেতেন না। কখনও আবার আগের দিন পরিবারের কেউ ব্লাড ব্যাঙ্কে এক ইউনিট রক্ত দিয়ে এলে তবেই তাঁরা পরের দিন শৌভিকের জন্য ‘ও’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত পেতেন। প্রথম দু’বছর এ ভাবেই চলেছিল। মুরারিবাবুর কথায়, ‘‘সব আত্মীয়েরা মিলেই বছরের কোনও না কোনও সময়ে রক্ত দিতাম। তাতে ভাইপোর সমস্যা মিটত। কিন্তু ওর মতো আরও অনেকের কথা ভেবেই এক দিন নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিই, পরিবারের তরফে বছরে দু’টি রক্তদান শিবির করার। আমরা যে ভাবে রক্তের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, অন্যকে তার থেকে রেহাই দিতেই ওই প্রয়াস ছিল।’’
প্রথম দু’বছর স্থানীয় কয়েকটি সংগঠনের সহযোগিতায় শিবিরের আয়োজন হয়। সেখানে মুরারিবাবুদের কলকাতার বাইরে থেকে এসে আত্মীয়েরা রক্ত দিয়েছেন। ৬০-৭০ ইউনিট রক্ত মিলত সেখান থেকেই। ১৯৯৪ থেকে অবশ্য মুরারিবাবুদের বাড়িতেই শিবিরের আয়োজন শুরু হয়। তার এক মাস আগেই আত্মীয়দের তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়। হাজির হন সকলে। তাঁদের দেখাদেখি আত্মীয়দের পরিচিতেরাও এখন রক্ত দিতে আসেন। রবিবারের শিবিরে প্রায় ৭৮ জন রক্ত দিয়েছেন।
যাঁদের কথা ভেবে এই দু’ দশকের পরিকল্পনা, তাঁরা কী ভাবে উপকৃত হচ্ছেন? মুখোপাধ্যায় পরিবার জানায়, কখনও রক্তের কার্ড পরিবারের কারও কাজে লাগে, কখনও আবার তার সবক’টাই দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার মুরারিবাবুর দাবি, ‘‘দরিদ্র মানুষদের রক্তের কার্ড দেওয়ার পরে তাঁরা ঠিক মতো রক্ত পেলেন কি না, তারও খেয়াল রাখি।’’
হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শুভ উদ্যোগ। যে পরিবারে থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছেন তাঁরাই বোঝেন এর জন্য রক্ত কতটা জরুরি। তাই ওই পরিবারটি এই রক্তদান শিবিরের পাশাপাশি যদি এই ধরনের কোনও সচেতনতা বাড়ানোর শিবির করলে সেটা আরও ভালো হবে।’’
রক্ত আন্দোলনের কর্মী ডি আশিসের কথায়, ‘‘যাঁরা উপহারের লোভে রক্ত দেন, তাঁদের কাছে ওই পরিবারটি দৃষ্টান্ত। ওঁরা দেখিয়েছেন উপহার না দিয়েও কেমন ভাবে মহৎ উদ্দেশে রক্তদান শিবির করা যায়। থ্যালাসেমিয়া শিশুরা রক্তের বিনিময়েই বেঁচে থাকে। নিজেদের ঘরে ঘটেছিল বলেই ওঁরা উপলদ্ধি করেছিলেন রক্তের সঙ্কটের সমস্যা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy