ঝড় উঠলে যে ভাবে রাস্তায় গাছ উপড়ে পড়ে, সে ভাবে শব্দবাজি ফাটানোর ফলে তৈরি হওয়া বায়ুর চাপও বহু ক্ষেত্রে সজোরে কানে আছড়ে পড়ে ক্ষতি করে শ্রবণযন্ত্রের। শব্দদানবের দাপাদাপিতে হারিয়ে যায় উচ্চ তরঙ্গের (হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ধ্বনি। চিকিৎসক-গবেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, শব্দবাজির দাপটে ব্যঞ্জনধ্বনি শোনার অভিজ্ঞতাই বদলে যাচ্ছে বহু ভুক্তভোগীর।
শব্দবাজির আওয়াজ নির্দিষ্ট পরিসরে বায়ুর চাপ বাড়িয়ে দেয়। এতটাই বাড়ায় যে, সেই চাপ ঘনীভূত হয়ে আছড়ে পড়ে কানের পর্দায়।
এটা অনেকটা প্রবল ঝড়ের মতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র রিপোর্ট বলছে, বাতাসে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতির পরেই শব্দদূষণ সাধারণ স্বাস্থ্যের পক্ষে অন্যতম ক্ষতিকারক। কিন্তু তার পরেও শহরে কালীপুজো-দীপাবলিতে শব্দবাজির জেরে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছে, তাতে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। শব্দবাজির আওয়াজ ব্যঞ্জনধ্বনি শোনার অভিজ্ঞতাও পাল্টে দিচ্ছে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। কালীপুজো-দীপাবলির সময়ে রোগীদের পরীক্ষা করে এমনই তথ্য উঠে এসেছে চিকিৎসক-গবেষকদের একাংশের কাছে। কারণ হিসেবে তাঁরা জানাচ্ছেন, শব্দবাজির কারণে উচ্চ তরঙ্গের (হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ধ্বনি শোনার ক্ষেত্রে বধিরতা তৈরি হয়। ফলে পুরো শ্রবণ-অভিজ্ঞতাই পাল্টে যায়।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে শব্দবাজির মাত্রা কেন ৯০ ডেসিবেল হওয়া উচিত, তার স্বপক্ষে তথ্য সংগ্রহ করেছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। আট জন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে পর্ষদ দেখিয়েছিল, ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দে শ্রবণযন্ত্রের সমস্যা থেকে শুরু করে স্থায়ী শারীরিক ক্ষতি পর্যন্ত হতে পারে। ওই কমিটির রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করেই শেষ পর্যন্ত এ রাজ্যের ক্ষেত্রে শব্দবাজির মাত্রা ৯০ ডেসিবেল ধার্যের পক্ষে রায় দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা।
আরও পড়ুন: আজ টেস্ট, কাল ফাইনাল, বাজির দাপট রোখার পরীক্ষায় পুলিশ
ওই বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য তথা ইএনটি চিকিৎসক শান্তনু পাঁজা বলেন, ‘‘কানের খুব কাছে শব্দবাজি ফাটলে ওই নির্দিষ্ট পরিসরে যে বায়ুচাপ তৈরি হয়, তা প্রবল ভাবে কানের পর্দায় গিয়ে ধাক্কা মারে। তাতে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে, কানের ভিতরে যে ছোট ছোট হাড়, যেগুলো শ্রবণযন্ত্রের সহায়ক, সেগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’’ ওই কমিটির চেয়ারম্যান দুলালচন্দ্র বসু বলেন, ‘‘অনেক সময়ে পর্দা ফাটে না, কিন্তু অন্তঃকর্ণের গুরুতর ক্ষতি করে দেয় শব্দবাজি।’’
ওই কমিটিরই সদস্য ইএনটি চিকিৎসক অনির্বাণ বিশ্বাস জানাচ্ছেন, শব্দবাজির বিকট আওয়াজে ব্যঞ্জনধ্বনি কম শোনেন অনেকে। ব্যঞ্জনধ্বনি না শুনলে কথার পুরো অর্থ পরিষ্কার হয় না। কারণ, কথার মানে বুঝতে গেলে ব্যঞ্জনধ্বনি শোনা বা তার অর্থ পরিষ্কার হওয়া দরকার। অনির্বাণবাবুর কথায়, ‘‘অনেক ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চ তরঙ্গের। কিন্তু সেগুলি পরিষ্কার শোনা না গেলে কথার অর্থ বোঝা যাবে না। কেউ কিছু বলছে, এটা বোঝা যায়। কিন্তু কী বলছে, তা বোঝা যায় না। এটা খুব হতাশা তৈরি করে।’’
ভাষাবিদদের একাংশ অবশ্য জানাচ্ছেন, সব ব্যঞ্জনধ্বনি যে উচ্চ তরঙ্গের, তা নয়। যে ধ্বনিগুলি উচ্চারণের সময়ে একটু বেশি সময় ধরে বাতাস বেরোয় (যেমন হ, র, ল), সেগুলির তরঙ্গ বেশি হতে পারে। তবে শ্রবণক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে ব্যঞ্জনধ্বনি কম শোনা যায়, সে ব্যাপারে একমত তাঁরা। ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘এমনিতেই ব্যঞ্জনধ্বনি কম শুনি আমরা। তার উপরে শ্রবণক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যঞ্জনধ্বনি কমই শোনা যাবে। কথার অর্থ পরিষ্কার হবে না।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অভিজিৎ মজুমদারের কথায়, ‘‘এটা মানসিক ট্রমার মতো। কোনও মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ যেমন আশপাশের লোকজন কী বলছেন, তা শুনতে পান, অথচ তা বুঝতে পারেন না। তেমনই শব্দবাজির অতর্কিত আওয়াজ শ্রবণশক্তির পাশাপাশি অনুধাবন স্তরেরও ক্ষতি করে।’’
তবে গবেষক-চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শব্দবাজির মাত্রা ৯০ ডেসিবেল ধার্য হলেও যদি ধারাবাহিক ভাবে ওই আওয়াজের মধ্যে থাকতে হয় কাউকে, তা হলেও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। দুলালবাবুর কথায়, ‘‘১২০ ডেসিবেলের বেশি আওয়াজ হলে কানের পর্দা ফেটে যায়। কিন্তু ৯০ ডেসিবেল আওয়াজের মধ্যে চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে কেউ থাকলেন, তাতেও অনেক শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। সেটাও মাথায় রাখতে হবে সকলকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy