Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

স্কুল থেকে পুলকার, চলে খুদেদের ঝুঁকির ‘রেলগাড়ি’

জিটি রোডের ধার দিয়ে ছুটে চলেছে ‘রেলগাড়ি’! তবে এ রেলগাড়ি ইঞ্জিন-চালিত নয়। একে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক যুবক। আর তাঁর হাত ধরে থাকা এক খুদের পিঠ ছুঁয়ে রয়েছে আর এক জন, পরপর কাঁধ ধরে বাকিরা।

পুলকার থেকে নেমে এ ভাবেই স্কুলে যাওয়া। —নিজস্ব চিত্র।

পুলকার থেকে নেমে এ ভাবেই স্কুলে যাওয়া। —নিজস্ব চিত্র।

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:০৯
Share: Save:

জিটি রোডের ধার দিয়ে ছুটে চলেছে ‘রেলগাড়ি’!

তবে এ রেলগাড়ি ইঞ্জিন-চালিত নয়। একে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক যুবক। আর তাঁর হাত ধরে থাকা এক খুদের পিঠ ছুঁয়ে রয়েছে আর এক জন, পরপর কাঁধ ধরে বাকিরা। সামনের জন বেশি দ্রুত এগিয়ে গেলে পিছনের জনও তাল মেলাতে ছুট লাগাচ্ছে। আর খুদে পড়ুয়াদের এই ‘রেলগাড়ি’র পাশ দিয়েই বিপজ্জনক ভাবে তীব্র গতিতে চলেছে যানবাহন। কখনও সাইকেল বা মোটরবাইকের সঙ্গে রেলগাড়ির ধাক্কা লাগে না, এমনটাও নয়।

প্রতিদিন সকাল-দুপুরে লিলুয়া এলাকার স্কুলগুলি থেকে কয়েকশো মিটার দূরে দাঁড় করানো স্কুলগাড়ি পর্যন্ত এ ভাবেই দল বেঁধে যাতায়াত করে খুদে পড়ুয়ারা। তিন-পাঁচ-সাত বছরের বাচ্চাগুলির কাছে এ ভাবে যাতায়াত করাটা মজার খেলার মতো হলেও প্রতি পদে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বলেই মনে করে পুলিশ ও এলাকাবাসী। পার্কিংয়ের সমস্যায় রাস্তার ধারে পুলকার দাঁড়াতে দেয় না পুলিশও। তাদের যুক্তি, যে সমস্ত স্কুলে জায়গা রয়েছে, সেখানে পালা করে স্কুলগাড়ি ঢুকতে দেওয়া হোক। তাতে অন্তত বিপদের আশঙ্কা থাকবে না।

মঙ্গলবার লিলুয়া বড় গেটের সামনে বারো জন খুদে পড়ুয়াকে দাঁড় করিয়ে বেপাত্তা হয়ে যান পুলকারের খালাসি। টানা এক ঘণ্টা অপেক্ষার পরে খুদেরা কান্নাকাটি জোড়ে। পরে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, লিলুয়া এলাকার সমস্ত স্কুলের পড়ুয়াদের রোজ এ ভাবেই দল বেঁধে ব্যস্ত রাস্তা ধরে কয়েকশো মিটার দূরে দাঁড়ানো স্কুলগাড়ি পর্যন্ত যেতে হয়।

এর কারণ, কোনও স্কুলেই পুলকার ঢোকার অনুমতি নেই। আবার পুলিশও জিটি রোড বা অন্য ব্যস্ত রাস্তায় স্কুলের গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে দেয় না। বুধবার লিলুয়ার বিভিন্ন স্কুলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি স্কুল থেকেই খুদে পড়ুয়ারা বেরিয়ে রাস্তার ধার ধরে ছুটছে। লাইনের সামনে বা পিছনে স্কুলগাড়ির চালক। কখনও রাস্তার ধারের রিকশা ও লরির ফাঁক দিয়ে গলতে হচ্ছে, কখনও বা তীব্র গতিতে ছুটে আসা লরি ও বাসের ধাক্কা থেকে বাঁচতে নর্দমায় নেমে যাচ্ছে শিশুরা।

ব্যস্ত রাস্তায় তীব্র গতির যানবাহনে ধাক্কা লাগতে পারে কোনও শিশুর। কেউ হাত ছিটকে দল থেকে আলাদা হয়ে পড়তে পারে। অসৎ উদ্দেশ্যে কেউ পিছন থেকে কোনও বাচ্চাকে সরিয়েও নিয়ে যেতে পারে— এমন অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কায় এলাকাবাসীই। যদিও পুলকার চালকদের কথায়, ‘‘আমরা বাধ্য হয়েই দূরে গাড়ি দাঁড় করাই। স্কুলে আসা ও ছুটির পরে বাচ্চাদের রেলগাড়ি খেলার নাম করে লাইন করিয়ে নিয়ে যাই। জানি, বিপদ হতে পারে। কিন্তু অন্য উপায়ও তো নেই।’’

সমস্যা মেনে নিয়ে হাওড়া সিটি পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) সুমিত কুমারও বলছেন, ‘‘স্কুলে পুলকার ঢোকানো বা তার নির্দিষ্ট পার্কিংয়ের জায়গার জন্য বহু বার স্কুলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছি। লাভ হয়নি। আবার ব্যস্ত রাস্তায় পুলকার দাঁড়ালে যানজট হবে। তারও অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, জিটি রোড, গিরিশ ঘোষ রোড, লিলুয়া স্টেশন রোড মিলিয়ে প্রায় ন’টি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল রয়েছে লিলুয়ায়। প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার পড়ুয়া ওই সমস্ত স্কুলে আসে। আসে কয়েক হাজার মোটরবাইক, কয়েকশো ভ্যানরিকশা ও প্রায় তিনশোর মতো স্কুলগাড়ি। সব মিলিয়ে জট পাকিয়ে যায় গোটা এলাকায়। স্থানীয় কাউন্সিলর কৈলাস মিশ্র বলেন, ‘‘বাচ্চাগুলোকে দেখলে কষ্ট হয়। বৃষ্টি হলে ভিজতে ভিজতে যায়। প্রয়োজনে পুরসভা, পুলিশের সঙ্গে কথা বলে স্কুল একটা পথ বার করুক।’’

যদিও স্কুল চত্বরে স্কুলগাড়ি ঢোকার মতো জায়গা নেই বলেই দাবি করছেন কর্তৃপক্ষেরা। মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্কুলটির অধ্যক্ষ নীলকণ্ঠ গুপ্ত বলেন, ‘‘এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বাচ্চাদের নিরাপত্তার বিষয়ে পুলকার চালক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলব। তবে স্কুল চত্বরে পুলকার ঢোকার মতো জায়গা নেই। কিন্তু স্কুল থেকে পুলকার পর্যন্ত যাওয়ার সময়ে বাচ্চাদের নিরাপত্তা দেওয়ারও চেষ্টা করব।’’ জিটি রোডের ধারের আর এক স্কুল পরিচালন সমিতির কর্তা অধিরাজ সিংহ বলেন, ‘‘স্কুল চত্বর থেকে বাচ্চা বাইরে চলে গেলে দায়িত্ব আমাদের নয়। তখন পুলকার চালকদের দেখা উচিত।’’ লিলুয়া স্টেশন রোডের আর একটি স্কুলের অধ্যক্ষ এস কে শ্রীবাস্তবের দাবি, ‘‘আমাদের স্কুলের কাছেই পুলকার রাখা হয়। কখনও কোনও অঘটন ঘটেনি। আমদের স্কুলের ভিতরে বাইক ঢোকার অনুমতি রয়েছে। অন্যরা তো তা-ও দেয় না।’’

এলাকাবাসীর মতে, এক দিকে স্কুলের ভিতরে পর্যাপ্ত জায়গার অভাব, অন্য দিকে রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করাতে না দেওয়া— সমস্যার এই জোড়া ফলার সামনেই ঝুলে রয়েছে কচিকাঁচাদের নিরাপত্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pool car
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE