দুই গোষ্ঠীর সিন্ডিকেটের মধ্যে পর পর দু’বার লড়াইয়ের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠল রাজারহাট। অভিযোগ, প্রথমে রাজারহাটের বাবলাতলার গোলমালের জের গিয়ে পৌঁছয় দমদম মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে। আর এর ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ফের দুই সিন্ডিকেটের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ বাধে নিউ টাউন অ্যাকশন এরিয়া টু-এ। প্রথম ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে ন’জন, দ্বিতীয় ঘটনায় ২২ জন। অভিযোগ, শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই এই সংঘর্ষ হয়।
এতদিন দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমাল হয়েছে রাজারহাট-নিউ টাউনের রাস্তাঘাট, মাঠ-ময়দান, এমনকী রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের ভিতরেও। কিন্তু বৃহস্পতিবার
রাতের ঘটনা সে সবকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এ বারের ঘটনাস্থল হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে।
অভিযোগ, ওই রাতে ১২টা নাগাদ নিরাপত্তারক্ষীকে ঠেলা মেরে ফেলে হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে মোটরবাইক নিয়ে ঢুকে পড়েন প্রায় ২০ জন যুবক। হঠাৎই সেখানে একটি বেডে শুয়ে থাকা এক যুবককে ধরে মারতে উদ্যত হন কয়েকজন। তা দেখে অন্য কয়েকজন যুবক সেখানে ছুটে এলে কার্যত সেখানেই শুরু হয়ে যায় খণ্ডযুদ্ধ। তখন কেউ ওই অসুস্থ যুবকের বেড ধরে ধাক্কা দিচ্ছেন, কেউ হাসপাতালের বেডে উঠে দাপাচ্ছেন, কেউ বা হাতের হেলমেট দিয়ে মারছেন একে অপরের মাথায়, কেউ তছনছ করছেন হাসপাতালের বিছানা। তা দেখেএক রোগী ইমার্জেন্সি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। আর চিকিৎসক ও নার্সেরা সিঁটিয়ে থাকলেন ইমার্জেন্সিতেই।
ইমার্জেন্সির ভিতর এই দৃশ্য ধরা পড়েছে সিসিটিভিতে। তবে পুলিশ জানায়, কোনও রোগীর ভুল চিকিৎসা বা মৃত্যুর ক্ষোভে নয়, ইমার্জেন্সিতে এই আক্রমণের কারণ রাজারহাটের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ।
অন্য বারের মতো এ বারও অভিযোগ, এলাকার সিন্ডিকেট দখলকে কেন্দ্র করে রাজারহাটের তৃণমূল সাংসদ কাকলী ঘোষ দস্তিদার ও বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের অনুগামীদের মধ্যেই এই গোলমাল হয়েছে। দমদম থানার পুলিশ জানায়, হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ঢুকে মারপিট ও সরকারি কর্মীদের ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে ৯ জন গ্রেফতার হয়েছে। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক কর্তা বলেন, ‘‘পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ন’জনকে ধরে। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। স্বাভাবিক কাজকর্মও হচ্ছে হাসপাতালে।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, ঘটনার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার রাতে। এ দিন অঞ্জন ঘোষ ওরফে নানা নামে এক যুবক রাজারহাটের বাবলাতলার রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছিলেন। অঞ্জন এলাকার তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত। স্থানীয় সূত্রে খবর, তাঁকে সাংসদ কাকলী ঘোষ দস্তিদারের মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। অভিযোগ, এ দিন বাড়ি ফেরার সময়ে এলাকারই কয়েকজন তৃণমূল সমর্থক তাঁকে কটূক্তি করেন। এর পর অঞ্জনেরও কয়েকজন সঙ্গী সেখানে চলে আসেন। অভিযোগ, অঞ্জন যাঁদের সঙ্গে বচসায় জড়ান, তাঁরা বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের অনুগামী বলে পরিচিত। বচসা হাতাহাতির আকার ধারণ করলে দু’পক্ষেরই কয়েকজন জখম হন। অঞ্জনকে নিয়ে যাওয়া হয় দমদম মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে। অভিযোগ, অঞ্জনকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে আনার কিছুক্ষণের মধ্যে ফের সেখানে কয়েকজন হামলা করতে আসেন এবং শুরু হয় হাতাহাতি। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানালে ন’জনকে গ্রেফতার করা হয়।
হাসপাতালের এক কর্মী বলেন, ‘‘আমাদের একজন এগিয়ে কিছু বলতে গেলে ওঁরা বললেন, এটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। নাক গলাবেন না। আর এগোনোর সাহস করিনি।’’ হাসপাতালের কর্তব্যরত এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘চোখের সামনে এ রকম ঘটনা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।’’ হাসপাতাল সূত্রে খবর, ঘটনার পরে ওই চিকিৎসক এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে ফের তিনি কাজে যোগ দেবেন কি না, তা নিয়ে ভেবে জানাবেন বলেছেন। হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সমীর ঘোষ দস্তিদার বলেন, ‘‘পুলিশ না এলে কী যে হতো, ভাবতেই ভয় করছে।’’
এলাকার বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত অবশ্য এই ঘটনাকে সিন্ডিকেটের ঝামেলা বলতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘‘ভোটের কাজে বসিরহাটে আছি। শুনেছি কোনও এক মত্ত যুবকের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে এই ঘটনা ঘটেছে। ওই মত্ত যুবককে মারধর করেন অঞ্জন। এর পরে তাঁকেই আবার একদল লোক মারধর করেন। হাসপাতালে কী হয়েছে জানা নেই।’’ কাকলীদেবীকেও ফোনে পাওয়া যায়নি। পরে তিনি এসএমএস–এ উত্তর দেন, ‘‘মিটিং এ রয়েছি। কী হয়েছে জানা নেই।’’
বৃহস্পতিবারের গোলমালের রেশ থেকে যায় শুক্রবার সারাদিন। এ নিয়ে রাজারহাটের বিভিন্ন এলাকায় ছিল উত্তেজনা। এর পরেই শুক্রবার দুপুরে ফের রাজারহাটে একটি জমির প্লটে ইমারতি দ্রব্য ফেলা নিয়ে মারপিট চলে দুই সিন্ডিকেটের। অভিযোগ, অ্যাকশন এরিয়া টু-এর একটি প্লটে বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের অনুগামীদের নিয়ে তৈরি নবদিশা নামে একটি সিন্ডিকেটের সদস্যেরা ইমারতি দ্রব্য ফেলতে এলে তাঁদের বাধা দেয় ড্রিমল্যান্ড নামে একটি সিন্ডিকেট। শুরু হয় বচসা। স্থানীয় সূত্রে খবর, ড্রিমল্যাল্ড সিন্ডিকেটের বেশিরভাগ সদস্যই সাংসদ কাকলী ঘোষ দস্তিদারদের অনুগামী। অভিযোগ, প্রথমে ড্রিমল্যান্ড সিন্ডিকেটের লোকজন নবদিশার কিছু সদস্যকে মারধর করেন। এর কিছু পরে নবদিশার লোকেরা দলবল নিয়ে ড্রিমল্যান্ডের উপর চড়াও হন। দু’দলের মারপিটে আহত হন ৯জন। এদের মধ্যে ৩ জন হাসপাতালে ভর্তি। এ দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালায়। পুলিশ কয়েকজনকে ধরে ও ৩২টি মোটরবাইক বাজেয়াপ্ত করে। বিকেলে আবার দুই সিন্ডিকেটের লোকজন নিউটাউন থানা ঘেরাও করেন। দু’পক্ষেরই অভিযোগ, তাদের দলের কয়েকজনকে মিথ্যা অভিযোগে ধরা হয়েছে। এর পরে ঘেরাওকারীদের কয়েকজনকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, এই ঘটনায় ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘‘কিছু দুষ্কৃতী এলাকায় অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। পুলিশকে কড়া হাতে দমন করতে বলেছি।’’ বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম বলেন, ‘‘সিন্ডিকেটের কোনও ধরনের দাদাগিরি বরদাস্ত করা হচ্ছে না। অভিযোগ পেলেই কড়া হাতে দমন করা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy