Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মূর্তি ভাঙতেই খোঁজ বাড়ল বর্ণপরিচয়ের

গত মঙ্গলবার অমিত শাহের মিছিল কলেজ স্ট্রিটের যে পথ দিয়ে গিয়েছিল, তার দু’ধারের অসংখ্য বই দোকানিরও একই বক্তব্য। তাঁরা জানাচ্ছেন, রাতারাতি বিক্রি বেড়ে গিয়েছে কি না, মাস শেষের হিসেবে বসার আগে বলা যাবে না।

চর্চা: দেব লাইব্রেরিতে সুকুমার মল্লিক। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র

চর্চা: দেব লাইব্রেরিতে সুকুমার মল্লিক। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৯ ০২:৩০
Share: Save:

কলেজ স্কোয়ার শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে দেব লাইব্রেরির ঘর জুড়ে সার সার বই। নানা লেখকের মধ্যে আলাদা করে জায়গা রয়েছে তাঁর। সে দিক থেকেই কয়েকটি ‘বর্ণপরিচয়’ হাতে তুলে নিয়ে লাইব্রেরির ইন-চার্জ সুকুমার মল্লিক বলেন, ‘‘হঠাৎই যেন সকলে বিদ্যাসাগর নিয়ে মেতে উঠেছেন। আমাদের দোকানেই গত কয়েক দিনে অনেকেই বর্ণপরিচয় নিতে এসেছেন। এ সব মূর্তি ভাঙার জন্য হচ্ছে কি না, জানি না। তবে বিদ্যাসাগর কোথাও যেন নতুন করে ভেসে উঠেছেন।’’

গত মঙ্গলবার অমিত শাহের মিছিল কলেজ স্ট্রিটের যে পথ দিয়ে গিয়েছিল, তার দু’ধারের অসংখ্য বই দোকানিরও একই বক্তব্য। তাঁরা জানাচ্ছেন, রাতারাতি বিক্রি বেড়ে গিয়েছে কি না, মাস শেষের হিসেবে বসার আগে বলা যাবে না। কিন্তু অনেকেই আসছেন বর্ণপরিচয়ের খোঁজ করতে। অনেকে আবার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আসছেন শুধুমাত্র বইটা দেখাতে। এমনিতে সরস্বতী পুজোর আগে হাতেখড়ির জন্য বর্ণপরিচয়ের খোঁজ পড়ে। তা ছাড়া, এ বইয়ের খোঁজ করতে এখন বিশেষ কাউকে দেখা যায় না। সোমনাথ দত্ত নামে এক বই বিক্রেতা বলেন, ‘‘যাঁরা মূর্তি ভেঙেছেন, তাঁরাই বিদ্যাসাগর চর্চাকে নতুন ভাবে ফিরিয়ে এনেছেন।’’ কলেজ স্কোয়ারের মূল গেটের সামনের বিদ্যাসাগর মূর্তির দিকে দেখিয়ে সন্তু হালদার নামে আর এক বই বিক্রেতার দাবি, নতুন করে বর্ণপরিচয়ের বরাত দেওয়া এক সময়ে বন্ধই করে দিয়েছিলেন তাঁরা। গত বুধবার থেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি দেখে এক বান্ডিল লাল মলাটের বর্ণপরিচয় আনিয়ে রেখেছেন তিনি। তাতে বিক্রি কত হল? সন্তুর উত্তর, ‘‘যে বই বিক্রিই হত না, কাল এক শিক্ষক এসে সেই বইটিই এক বারে চারটে কিনে নিয়ে গিয়েছেন।’’

বইপাড়ার খবর, এখন বহু প্রকাশনা সংস্থা বর্ণপরিচয় বই বিক্রি করলেও, আগে বর্ণপরিচয়ের স্বত্ত্ব ছিল শুধু দেব সাহিত্য কুটিরের হাতে। তাদেরই দেব লাইব্রেরিতে বসে সাদা-ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত সত্তরোর্ধ্ব সুকুমারবাবু বলছিলেন, ‘‘সে দিন অমিত শাহের মিছিলটা কলেজ স্ট্রিট দিয়ে যাওয়ার আগেই আমি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। টিভি খুলে দেখি এই কাণ্ড। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে দেখে প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে মনে হচ্ছে, এতে ওঁকে নিয়ে চর্চা বাড়ল। নইলে কাচের বাক্সে বন্দি লোকটাকে সকলে কতটা চিনতেন?’’ দীর্ঘদিন অঙ্কের শিক্ষকতা করা সুকুমারবাবু এর পরে দাবি করেন, ‘‘চিনবেই বা কী করে? আমরা তো আজকাল ছেলে-মেয়েকে অ, আ পড়াই না। তারা এ, বি, সি, ডি শিখছে।’’ সেই সময়েই পাশে দাঁড়ানো সুদেষ্ণা ভট্টাচার্য নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘‘বিদ্যাসাগর বেঁচে গিয়েছেন।’’

দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার রূপা মজুমদার অবশ্য বললেন, ‘‘আমি বাক্যহারা। এক জন মানুষ এবং নারী হিসেবে প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করেছি। বিদ্যাসাগরের জন্যই আমার মতো মেয়েরা আজ কথা বলার জায়গায় এসেছে। তা ছাড়া বিদ্যাসাগরের বই বিক্রি করেই আমাদের পারিবারিক ব্যবসা এত বড় হয়েছে।’’ রূপা জানান, দেব সাহিত্য কুটিরের পঞ্চম প্রজন্ম তিনি। তাঁর অগ্রজেরা এক সময়ে বিদ্যাসাগরের বইয়ের স্বত্ত্ব কিনেছিলেন। তার আগে পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের বই ছাপা হত তাঁর নিজস্ব ছাপাখানায়। সেই ইতিহাস হাতড়েই রূপা বলেন, ‘‘সত্যিই মূর্তি ভাঙার জন্য যদি বর্ণপরিচয়ের বিক্রি বেড়ে থাকে, তা হলে ব্যথিত হব। বর্ণপরিচয়ের বিক্রি কোনও কারণ ছাড়াই বাড়া উচিত। বাংলা শিক্ষা শুরুর বইটা পড়তে কোনও কারণ লাগবে কেন!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE