সুড়ঙ্গের ‘ডেঞ্জার জোনে’ আটকে পড়া মেট্রো রেকটিতে আগে থেকেই ত্রুটি ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রেকটিকে কেন শনিবার রাতে নামানো হয়েছিল, সেই প্রশ্ন নিয়েই এখন তোলপাড় চলছে মেট্রোয়। সেই সঙ্গেই যথারীতি ঘটনার দায় নিয়ে শুরু হয়েছে চাপানউতোর।
মেট্রো সূত্রের খবর, শনিবার সুড়ঙ্গে আটকে পড়া এসি মেট্রোর দুই মোটরম্যানকে ওই রাতেই তলব করে নিয়ে যাওয়া হয় নোয়াপাড়া কারশেডে। সেখানে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাঁদের। রবিবারও ওই দুই মোটরম্যানকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন খোদ জেনারেল ম্যানেজার। নিজেও খতিয়ে দেখেন রেকটির অবস্থা। ওই ঘটনায় চালকদের নিয়ে বারবার টানাটানির পরে প্রশ্ন উঠেছে, চালকেরা শুধু গাড়িটি চালিয়েছিলেন। অর্থাত্ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র। কিন্তু যাঁরা গাড়িটিকে ফিট সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, তাঁরা কোথায়?
শনিবার রাত পৌনে ৭টা নাগাদ বেলগাছিয়া ও শ্যামবাজার স্টেশনের মাঝে ‘ডেঞ্জার জোনে’ আটকে পড়ে এসি (৯ নম্বর) রেকটি। তখন ট্রেনের সব কামরা ছিল ভিড়ে ঠাসা। প্রায় দেড় ঘণ্টা সুড়ঙ্গে আটকে থাকার পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় মেট্রোর উদ্ধারকারী দল। শনিবারই মেট্রো সূত্রে জানানো হয়েছিল, থার্ড রেল থেকে ট্রেনটি বিদ্যুত্ টানতে পারছিল না। তাই সেটি দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিদ্যুত্ না নিতে পারলেও কামরায় এত ধোঁয়া কী করে এল, তার কোনও ব্যাখ্যা দেননি মেট্রো কর্তৃপক্ষ। অথচ ওই ধোঁয়াতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কিছু যাত্রী। অর্থাত্ মেট্রো সরকারি ভাবে না জানালেও এটা পরিষ্কার, শুধু বিদ্যুত্ টানায় সমস্যাই নয়, আরও বড় কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল রেকটিতে। যার জেরেই এত দিনে ঘটনার পরে জেনারেল ম্যানেজারকেও নোয়াপাড়া ছুটতে হল।
রেকগুলির যা অবস্থা, তাতে যখন-তখনই যে যান্ত্রিক ত্রুটি হবে— সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছেন যাত্রী থেকে মেট্রোকর্তারা। কিন্তু কলকাতা মেট্রো রুটে যেটুকু পথ সবচেয়ে কঠিন, সে পথে ওই যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটলে কী ভাবে এবং কত কম সময়ে যাত্রীদের উদ্ধার করা যাবে সে ব্যবস্থাও যে মেট্রোকর্তাদের হাতে নেই, তা স্পষ্ট হয়ে গেল শনিবার। প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে যাত্রীদের উদ্ধার নিয়ে চার দিকে প্রশ্ন ওঠায় কর্তারা এখন সাফাই গাইছেন, তাঁরা রেলের নিয়ম (ম্যানুয়াল) মেনেই মিনিট ২০ সময় দেন মোটরম্যানকে। যাতে মোটরম্যানই যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে ট্রেনকে সচল করতে পারেন। তাতেও ট্রেন না নড়ায় উদ্ধারকারী দলকে পাঠানোর তোড়জোড় করা হয়।
মেট্রোকর্তাদের একাংশ অবশ্য বলছেন, নতুন এসি রেকগুলি পুরোটাই বিদ্যুত্-নিয়ন্ত্রিত। ফলে চালকের পক্ষে খারাপ হওয়া রেক ঘটনাস্থলে মেরামতি করা অনেকটাই অবাস্তব। চালকেরাও কেউ ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নন। তাই প্রতিটি ট্রেনে চালকের সঙ্গে এক জন করে মেকানিক রাখা উচিত। মাটির উপরে যে সব এসি সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস চলে, সেগুলিতেও মেকানিক রাখা হয়। এটাই রেলের নিয়ম। কিন্তু মেট্রো রাখে না। সুড়ঙ্গ দিয়ে যায় বলে মেট্রোয় মেকানিক থাকা সত্যিই জরুরি বলে মনে করেন চালকেরাও। মেট্রোকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, জোর করে চালকের ঘাড়ে ট্রেন সারানোর দায়িত্বের দায় চাপানো হচ্ছে। কিন্তু ন্যূনতম টুল-বক্স বা স্ক্রু-ড্রাইভারও থাকে না চালকের কেবিনে। শনিবার চালককে যা চাইতে শোনা যায় যাত্রীদের কাছে।
নিয়ম হল, কন্ট্রোলে বেশির ভাগ সময়ই থাকতে হয় কর্তাব্যক্তিদের। যাতে মাঝপথে ট্রেন খারাপ হলে চালকের থেকে ত্রুটি জেনে তার প্রতিকার বলতে পারেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ সময়েই উচ্চপদস্থ কর্তারা কেউই কন্ট্রোলে থাকেন না বলে অভিযোগ। ফলে একটু বেশি মাত্রায় গোলমাল হলে সামলাবে কে? শনিবার সেটা হয়েছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে মেট্রোর অন্দরে। ট্রেনটি যখন ডেঞ্জার জোনে আটকায় তখন ওই সময়টা (২০ মিনিট) ফেলে রাখার ভাবনাটাই মারাত্মক ভুল হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বারবার দুর্ঘটনার পরেও যাত্রীদের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি ঠিকই, কিন্তু অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলেছেন, শুধু নিচুুতলার কর্মী নন, ইলেট্রিক্যাল এবং অপারেশন দফতরের কর্তাদের কাছেও এই ঘটনার কৈফিয়ত্ তলব করা প্রয়োজন। না হলে সত্যি এক দিন ‘পালে বাঘ’ পড়বে এবং প্রাণ যাবে যাত্রীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy