Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

‘বাংলা’ নামে অঞ্চলটির নিজস্ব, বিশিষ্ট ইতিহাস

সেমন্তী ঘোষগত শতকের গোড়া থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত বাংলার যে রাজনৈতিক ইতিহাস, তাকে কেবল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের লেজুড় হিসেবে দেখাই বোধহয় যথেষ্ট নয়। বাংলার ইতিহাসের কিন্তু একটি বিশিষ্টতা ছিল, যাকে সেই বিশিষ্টতার দিক থেকেই ‘পড়া’ জরুরি। এ নিয়েও সন্দেহ চলে না যে, বাংলার সামাজিক ইতিহাস নিশ্চিত ভাবে তার ওই বিশিষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাসটি তৈরি করে তুলেছিল।

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

গত শতকের গোড়া থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত বাংলার যে রাজনৈতিক ইতিহাস, তাকে কেবল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের লেজুড় হিসেবে দেখাই বোধহয় যথেষ্ট নয়। বাংলার ইতিহাসের কিন্তু একটি বিশিষ্টতা ছিল, যাকে সেই বিশিষ্টতার দিক থেকেই ‘পড়া’ জরুরি। এ নিয়েও সন্দেহ চলে না যে, বাংলার সামাজিক ইতিহাস নিশ্চিত ভাবে তার ওই বিশিষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাসটি তৈরি করে তুলেছিল। শুনতে সহজ, তবু অনেক সময়ই ইতিহাস-চর্চার মধ্যে কথাগুলি তত সহজ থাকে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা হয়ে দাঁড়ায় একটা ‘বড়’ ইতিহাসের অংশমাত্র, ভারতের ‘বড়’ ইতিহাসের সাধারণ ধারাগুলি বোঝার অন্যতম সিঁড়ি কেবল। হয়তো-বা জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বা মার্ক্সীয় ইতিহাস, এমনকী উত্তর-মাক্সর্ীর্য় ইতিহাসেও ‘অঞ্চল’ বা ‘আঞ্চলিক’ আইডেন্টিটিকে ততটা গুরুত্ব দেওয়ার চল ছিল না বলেই ব্যাপারটা এমন ঘটতে পেরেছিল। সাম্প্রতিক কালে কিন্তু দেখা যাচ্ছে একটা অন্য রকম ধারা। ইতিহাস-ভাবনার মঞ্চে ‘অঞ্চল’ বেশ জরুরি হয়ে উঠেছে। তার একটা নতুন তাত্‌পর্য তৈরি হচ্ছে। বাংলার ইতিহাসেও এসেছে বেশ একটা নতুন জোয়ার— তার বিশিষ্ট ইতিহাসের নানা নতুন ব্যাখ্যা, নতুন অর্থ আর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে।

সব্যসাচী ভট্টাচার্যের নতুন বই দ্য ডিফাইনিং মোমেন্টস অব বেঙ্গল, ১৯২০-১৯৪৭ এই ধারায় অতি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। কেন এই বই জরুরি, এক কথায় বলতে গেলে— ১৯২০ থেকে বাংলার ইতিহাসের একটি নতুন, নির্মীয়মাণ ‘গতিরেখা’র কথা বলে এই বই, এবং দেখায় যে তার আগেকার সময়ের ‘রেনেসাঁস ইতিহাস’ থেকে আস্তে আস্তে সরে গিয়ে কী ভাবে ‘নতুন’ ধারাটি তৈরি হয়ে উঠছিল। এই নতুন ধারার মধ্যে আঞ্চলিক সত্তাবোধের একটা স্পষ্ট স্বীকৃতি ছিল। অনেক রকম সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রকাশের মাধ্যমে সেই অঞ্চল-বোধের সমৃদ্ধি ঘটছিল। বাংলার ইতিহাসের বিশিষ্ট রূপ ও গতিটি ফুটে ওঠে এই বিবরণটির মধ্য দিয়ে। বোঝা যায়, বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসের সংযোগ নিশ্চয়ই ছিল, আবার নানা রকম অসংযোগ ও বিরোধিতাও ছিল।

ঠিক সে জন্যই, বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস বোঝার জন্য বাঙালি ভাষা বা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও এগুলিকে যুক্ত করে আলোচনা করা দরকার। আর তাই, এক কালে যিনি অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রখ্যাত গবেষক-শিক্ষক হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন, সাম্প্রতিক কালে সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উত্‌সাহ (টকিং ব্যাক: দি আইডিয়া অব সিভিলাইজেশন ইন দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট ডিসকোর্স এবং রবীন্দ্রনাথ টেগোর: অ্যান ইন্টারপ্রিটেশন) অতিক্রম করে তিনি যখন প্রবেশ করেন সামাজিক ইতিহাস রচনায়— সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতির দক্ষ সমন্বয়ে তৈরি করে তুলতে পারেন একটা বৃহত্তর ছবি।

কী বলেন তিনি, কোন কোন কারণে ১৯২০-র দশক থেকে বাংলার ইতিহাসের এই নতুন ধারা তৈরি হয়? প্রথমত, নতুন এক বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়ে ওঠে এই সময়ে। এঁদের কাছে আঞ্চলিক সত্তাপরিচয় ছিল খুবই জরুরি। দ্বিতীয়ত, বাঙালি নারীর সামাজিক অবগুণ্ঠন মোচন ও ‘ভদ্রমহিলা’ গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশও এই নতুন ইতিহাসের বিশেষ দ্যোতক। তৃতীয়ত, বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার একটা বড় মঞ্চ খুলে যায় এই সময়ে, যেটাকে সব্যসাচী ভট্টাচার্য বলেন ‘vernacularization of the language of politics’। গড়ে ওঠে বাংলার নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক পথ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে যা জাতীয় রাজনীতির বিকল্প হিসেবেও দেখা দেয়। কংগ্রেসে গাঁধী-রাজনীতির পাশাপাশি একই সময়ে বাংলায় দেখতে পাওয়া যায় এমন কিছু রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা যাদের গাঁধী-রাজনীতির বিকল্প বললে এতটুকু অতিরঞ্জন হয় না। উল্লেখ্য, উনিশশো বিশ ও ত্রিশের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ, কিংবা চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য রাজনীতি, কিংবা ফজলুল হকের হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়বাদী রাজনীতি।

বাঙালি মুসলিম সমাজ ও রাজনীতি বোধের দীর্ঘ আলোচনা এই বইয়ের জরুরি অংশ: কী ভাবে এক দিকে তৈরি হয়ে ওঠে ‘মুসলিম বাংলা’র বিশিষ্টতা, এবং অন্য দিকে, বিশেষত ১৯৩৭ সালের পর, ধর্মীয় পার্থক্যের ভিত্তিতে জায়গা নেয় দূরত্বের রাজনীতি (politics of exclusion)। বইয়ের শেষ দুটি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে পরাধীন বাংলার শেষ কয়েকটি বছরের রাজনীতির তীব্র দোলাচল, এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ‘যুক্ত বাংলা’ পরিকল্পনার আদর্শ ও সম্ভাবনা। খুবই তথ্যনিষ্ঠ এই শেষ অংশটি, যদিও তুলনায় আমাদের খানিকটা চেনা ন্যারেটিভ। আর একটি কথা। বইয়ের প্রথম অংশে যে বিভিন্ন ধরনের বাংলা সূত্র-উপাদানে সমৃদ্ধ এই বই, শেষ অংশে এসে তার বদলে সরকারি নথিপত্রের উপর পরিচিত ঝোঁকটিই আবার ফিরে আসে। অবশ্য ঐতিহাসিক নিজেই ভূমিকায় এ কথা বলে দিয়েছেন। কারণটা বোঝাও কিছু কঠিন নয়।

সব মিলিয়ে, সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বই-এর বিরাট আকর্ষণ— ঐতিহাসিক সূত্রসন্ধানের বিচিত্রগামিতা। প্রধানত যে সরকারি দলিলপত্রের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস বহু দিন ধরে লেখা হয়ে এসেছে, তার সঙ্গে নানা ধরনের বাংলা ইতিহাস উপাদানকে, এমনকী বাংলা সাহিত্য উপাদানকে মেলানো হয়েছে এখানে। এই জায়গাটায় নতুন প্রজন্মের ইতিহাস-চর্চাকারীদের অনেক কিছু শেখার থেকে গেল। আরও দু-একটা কথা থেকে গেল ভাবার মতো। এই সময়ের বাংলায় যে আঞ্চলিক সত্তাবোধ তৈরি হয়ে উঠছিল, তার মধ্যে কী ধরনের বিরোধ বা বিভিন্নতা ছিল, কেনই বা ছিল? তাদের সমন্বয়ের মাধ্যমে কি অন্য কোনও রাজনীতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল? সেই রাজনীতির সামাজিক বা আদর্শগত ভিত্তিটা কত জোরালো ছিল বলে মনে হয়? এই সব প্রশ্নের গভীর প্ররোচনা রইল সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বইটির মধ্যে।

একই ধরনের বহুমুখী উত্‌স-সন্ধান নীলেশ বসুর বই রিকাস্টিং দ্য রিজিয়ন বইতেও। নামের মধ্যেই স্পষ্ট, প্রথম থেকেই নীলেশের বই-এর ভর অঞ্চল-সত্তার বিকাশের উপর। ঔপনিবেশিক বাংলায় বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতির গুরুত্ব ও তার সঙ্গে তাল রেখে তাদের নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক মানসিকতা নির্মাণ এই বইয়ের বিষয়। বাঙালি মুসলমান লেখকদের অনেক ধরনের লেখাপত্র উঠে এসেছে সূত্র হিসেবে, একটি বিকল্প আর্কাইভ-এর খোঁজ দিয়েছে। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে কী ভাবে রাজনীতি তৈরি হয়, রাজনৈতিক পথ খোঁজা হয়, এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তার মেলবন্ধন কী ভাবে বাঙালি মুসলমানকে একটি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মডেল করে তোলে, সেটাই তাঁর প্রতিপাদ্য। সুতরাং, কাজী নজরুল ইসলাম এখানে ফজলুল হক বা সোহ্‌রাওয়ার্দির মতো একই রকম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, বিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতা ও ঢাকার বিভিন্ন মুসলিম সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এখানে প্রধান আলোচ্য বিষয়, একেবারে শেষ অধ্যায়ে গিয়ে যা ১৯৪৭-উত্তর ইসলাম ও বাংলা বিষয়ে আলোচনায় পৌঁছয়, মৌলানা ভাসানি বা আবুল হাশিমের স্বাধীনতা-উত্তর ভাবনায় আইডেন্টিটির সন্ধান করে। বস্তুত, শেষ অধ্যায়টি এই বইয়ের একটি বড় সম্পদ, সীমান্তের দুই পারে বাঙালি মুসলিম সমাজের ভাবনাজগত্‌ এত দিন পর্যন্ত এক রকম অনালোচিতই ছিল।

১৯৪৭-এর সীমারেখার দুই দিক জুড়ে বাঙালি মুসলমানের আত্মানুসন্ধান একটি জরুরি কথা বুঝিয়ে দেয়: বাঙালি মুসলিম আইডেন্টিটির উপর ভর করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ও ‘বাংলাদেশ’-এর রাজনীতি নির্ধারিত হলেও এই আইডেন্টিটি ঠিক সাতচল্লিশ-পরবর্তী ঘটনা নয়, তার অনেক আগেকার ঐতিহ্য। এই আইডেন্টিটির সঙ্গে রাজনীতি কী ভাবে জড়িত ছিল, সেটা দেখলে বোঝা যায় ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে আমরা যে ভাবে এত দিন দেখে এসেছি, একটি বিশিষ্ট অঞ্চল হিসেবে দেখলে তার থেকে কিছু আলাদা ছবি, আলাদা সম্ভাবনা তৈরিও সম্ভব। দুটি বই-ই সেই আলাদা দৃষ্টিকোণের দিকে আমাদের এগিয়ে দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review semanti ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE