সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছিল ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। একটু বিলম্বে হলেও শতবর্ষের বছরেই বাংলাদেশের সুভাষ-শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ঢাকার প্রথমা প্রকাশন থেকে মতিউর রহমানের সঙ্কলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে বইটি।
সম্পাদক জানিয়েছেন, বড় পরিসরে স্মারক গ্রন্থের আয়োজন না করে তিনি চেয়েছেন বাংলাদেশে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রত্যক্ষ পরিচয়বাহী মানুষদের স্মৃতিকথন এবং কিছু প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ একত্র করতে। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রণেশ দাশগুপ্ত, শামসুর রাহমান, সনজীদা খাতুন, আনিসুজ্জামান, বেলাল চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক প্রমুখের লেখা এবং কিছু আলোকচিত্র আর প্রামাণ্য জীবনী ও গ্রন্থপঞ্জি নিয়ে এই নাতিদীর্ঘ সঙ্কলন।
প্রথম লেখা রণেশ দাশগুপ্তের ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা: কিছু কথা’। এই লেখাটি ১৯৭৫ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য সংকলন-এর ভূমিকা। ‘যাত্রাসঙ্গী সুভাষ মুখোপাধ্যায়’ শিরোনামে ব্যক্তিগত স্মৃতি-অনুষঙ্গী আর জাতীয় চেতনা উদ্রেককারী রচনায় সনজীদা খাতুন ১৯৫৪ সালে বিএ অনার্সের ছাত্রী থাকাকালে ঢাকার কার্জন হলে এক সাহিত্য সম্মেলনে আগত অন্যতম অতিথি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে পুষ্প-সম্ভাষিত করার স্মৃতিচারণ করেছেন। আনিসুজ্জামান ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আমার আলাপ’ শীর্ষক অন্তরঘন লেখায়, ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে আগত তাঁর ‘সুভাষদা’কে বিপরীত মেরুর দুই কবি ফররুখ আহমদ এবং বিপ্লবী ইলা মিত্রের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালনের অনুপম বিবরণ।
‘বাংলা আমার, বাংলাদেশ’ এবং ‘ওপারে যে বাংলাদেশ, এপারেও সেই বাংলা’র লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলার বাইরে, সুদূর সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন সীমান্ত ভ্রমণের অন্য রকম অনুভবের বিস্তার ঘটেছে হায়াৎ মামুদ এবং আবুল হাসনাতের স্মৃতিগদ্যে। ১৯৭৬ সালে তাসখন্দে এক সম্মেলনে ভারত থেকে যান সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও দেবেশ রায়। সম্মেলন শুরুর আগে দেবেশ সুভাষের টাই নিয়ে সুরসিক আপত্তি তুললে উত্তর আসে যে, ওই একটাই টাই আছে তাঁর। অগত্যা হায়াৎ ‘বিপত্তারণ দেবদূত’ হিসেবে হাজির হলেন তাঁর টাই নিয়ে। এ বার তাঁর সুভাষদা টাইয়ের নট বেঁধে দিতে অনুরোধ করলে হায়াতের বিস্ময়: “বছরে এত বার কনফারেন্সে যান, টাই বাঁধেন কী করে?” এ বার অবাক হন তিনি, নিজের বোকামি দেখে। “নতুন করে বাঁধব কী? ও তো বাঁধাই থাকে। আমি কেবল ফোকরে মাথা গলিয়ে পরে নিই। আমার টাইটা দেখ না।”
শামসুর রাহমানের লেখায় গত শতকের আশির দশকে এক সামরিক শাসকের আমন্ত্রণে বিতর্কিত কবিতা সম্মেলনে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণের বিরোধিতা আছে। তবে সুভাষের প্রতি অপার আস্থা থেকেই যে এই বিরোধিতা, সে সত্যেরও উচ্চারণ অনুক্ত নয় সুভাষ-কবিতানুরাগী শামসুর রাহমানের লেখায়।
সঙ্কলক ও সম্পাদক মতিউর রহমান ‘তিনি আমাদেরই লোক’ শীর্ষক সুদীর্ঘ লেখায় ১৯৭২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা, কলকাতা ও মস্কোয় দেখা, আড্ডা ও অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকায় বাংলা একাডেমির জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের অতিথি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির পথ চলার রক্তপলাশময় এমন স্মৃতি যেন যে কোনও বিস্মরণের ভাটার বিরুদ্ধে উজানের গান গেয়ে চলে। “এখনো ভেবে আন্দোলিত হই, একই সঙ্গে মন বিষাদে ভরে যায়, সেই কবে একুশের ভোরে মিছিলে হেঁটেছিলাম সুভাষদার সঙ্গে! এই একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে সুভাষদা কবিতা আর গদ্য দুই-ই লিখেছেন।”
পদাতিকের পা এক সময় থেমে যায়। তবু সেই কবিকে নিয়ে এই বই যেন নতুন করে আমাদের কানে কানে বলে যায় ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy