সকলেই জানেন, সারা জীবন ধরে ফরাসি সংস্কৃতিতে কবি অরুণ মিত্রের অনুরাগ ও আনুগত্য ছিল কতটা গভীর, ফরাসি শিক্ষা ও অনুশীলন একেবারে বাল্যকাল থেকে, প্রথমে কারও ব্যক্তিগত সহায়তায়, তারপর কলকাতার ফরাসি চর্চার প্রতিষ্ঠান আলিয়ঁস ফ্রঁস্যাজ-এর ছাত্র ও গ্রন্থাগারকর্মী হিসেবে, সাংবাদিকতাও সাময়িক ভাবে, ১৯৪৮-এ ফ্রান্সের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের জন্য গবেষণা, ফিরে এসে ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা বছর কুড়ি। অবশেষে কলকাতায় থিতু হয়ে পারিবারিক ও সাংসারিক অস্তিত্ব, বন্ধু সমাগম ও সহবত এবং পড়া ও লেখা নিয়েই কাটিয়ে দেন বাকি জীবনের আঠারোটি বছর। বস্তুত সেটাই ছিল তাঁর সৃজনের আর মননের শ্রেষ্ঠ সময়— কবিতা ও প্রবন্ধ রচনায়।
জাত-বিচার করে দু’টি খণ্ডে ভাগ করা হয়েছে অরুণ মিত্রের প্রবন্ধসংগ্রহ। প্রথম খণ্ডের লক্ষ্য সাহিত্য, বিশেষত কবিতা, এবং ফরাসি কবিতা সম্পর্কে যে প্রাঞ্জল ভাবনা বিশ শতকের শেষ দুই দশকে গ্রন্থস্থ হয়েছিল, তাদের স্থান করে দেওয়া। দ্বিতীয় খণ্ডে সেই সব প্রবন্ধ যেখানে কোনও না কোনও ভাবে স্মৃতিচারণই তাঁর সমস্ত ভাবনার সঞ্চালক। কবিতা লেখা ছাড়া জীবনে যা কিছু করেছেন, সাংবাদিকতাই হোক বা শিক্ষকতা, সে সময়ও তাঁর মনপ্রাণ ছিল কবিতা নিয়েই। ইলাহাবাদের নিঃসঙ্গ শিক্ষকতার জীবনে তাঁর একান্ত টান ছিল কবিতারই জন্য। আর সে কারণেই বলতেন, ‘জাত শিক্ষক আমি নই। কেননা শিক্ষার ব্যাপার নিয়ে সাধারণভাবে কোনো চিন্তা আমার মাথায় আসত না, আমার মনে ঘুরে-ফিরে আসত কবিতার ভাবনা...’।
১৯২৫, যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬, তখন থেকেই কবিতা লেখার শুরু কিশোর পত্র-পত্রিকায়, তারপরও রাজনীতি-অনুবাদ-সাংবাদিকতা নিয়ে যখন তিনি ব্যস্ত, তখনও কবিতানুরাগ ছিল আড়ালে। ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের যুগে ‘লাল ইস্তাহার’ বা ‘কসাকের ডাক’ জনপ্রিয় হয়েছে, তবে বইতে বেরোয়নি। প্রবন্ধও তিনি লিখেছেন পাশাপাশি। প্রথম প্রবন্ধ তো বেশ আদ্যিকাল থেকেই। ১৯২৯-এ ছাত্রবয়সে লেখা ‘আলফাঁস দোদে’ থেকে ১৯৫২-’৫৩ পর্যন্ত যে-সব টুকরো প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, আগেই জানি, সেগুলি মূলত ফরাসি লেখকদের প্রবন্ধের অনুবাদ। সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি কবিতার অজস্র অনুবাদও তো তিনি নিজেই অবিরল করে চলেছেন। সেই সঙ্গে ফরাসি কবি ও কবিতা সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক মৌলিক প্রবন্ধও ছাপা হচ্ছে। ভিক্তর য়্যুগো, বোদলের, র্যাঁবো থেকে শুরু করে স্যুররেয়ালিস্তরা এবং আরাগঁ, এল্যুয়ার, স্যুপেরভিয়েল, আপোলিনের, স্যাঁ-ঝন পের্স, ঝাঁ কক্তো, ঝাক প্রেভের, আঁরি মিশো, র্যনে শার প্রমুখ— তাঁদের কবিতার অনুবাদের সঙ্গে তাঁদের কবিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে একক বা যুক্ত অনুচিন্তনও। ১৯৮৫-তে প্রকাশিত তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বই ফরাসি সাহিত্য প্রসঙ্গে-তে এই সব বিষয়ই এসেছে। এবং আরও নানা কথা, যেমন ফরাসি কবিতার সূত্রে বাংলা কবিতার সমান্তরাল সূত্র। ওখানেই ‘শতাব্দীর কণ্ঠ’-তে আছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্তর য়্যুগো-র বিস্তারিত তুলনা। তারিফ জানিয়েও শেষ পর্যন্ত বুদ্ধদেব বসু-র অনুবাদ নিয়ে প্রভূত সংশয়। লক্ষণীয়, গদ্যপদ্যের বিবাদভঞ্জন কতখানি যে স্বচ্ছ ফরাসি সাহিত্যের প্রয়াসে ও উপার্জনে, বাংলা সাহিত্যেও সেই অভিজ্ঞতারই শিক্ষা তাঁর একাধিক প্রবন্ধে। ‘বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি পদ্য একটু একটু করে জমি ছাড়ছে গদ্যের সামনে। বাংলা কবিতার দিকে তাকালেও তা বোঝা যায়’। পরন্তু ‘ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাসে সুদীর্ঘকাল গদ্য এবং পদ্য নিয়ে বিতর্ক এক আশ্চর্য ঘটনা’ এই নিয়ে শুরু করেছেন অরুণ মিত্র তাঁর ‘গদ্য, না পদ্য: ফরাসি বিবাদ-বৃত্তান্ত এবং কিছু বাঙালি ভাবনা’ প্রবন্ধটি। ফরাসি সাহিত্যের ‘রংবদল’-এর দীর্ঘ বর্ণনার পর তিনি দেখিয়েছেন গদ্যের দিকে পদ্যের যাওয়াটা বাঙালি লেখক ও পাঠকদের কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ। এবং তার একটা বড় সাক্ষ্যই অন্য অনেকের পাশে অরুণ মিত্রেরও কাব্যধরন।