E-Paper

পুরাণ ও মহাভারতের মণিকণা

গল্পের পাদটীকায় লেখক জানিয়েছেন, এই কাহিনিটি তিনি পদ্মপুরাণ থেকে নিয়েছেন। মহাভারতের বনপর্বে অবশ্য এই গল্পটাই অন্য ভাবে আছে।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪ ০৭:১৪
কথামৃত: মহর্ষি শুকদেবের সামনে পরীক্ষিৎ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে আঁকা ছবি।

কথামৃত: মহর্ষি শুকদেবের সামনে পরীক্ষিৎ। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে আঁকা ছবি।

দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর নাম তো সকলেই জানেন। কিন্তু পাঁচ স্ত্রীর একই স্বামী? এই বইয়ে বেদনিধি মুনির পুত্র অগ্নিপ ঋষির কথা আছে। হিমালয় পর্বতের সানুদেশে অচ্ছোদ সরোবরে তিনি স্নান করতে এসেছেন, তাঁকে দেখে পাঁচ গন্ধর্বকন্যা একেবারে মুগ্ধ। যাকে বলে, ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’! প্রমোদিনী, সুশীলা, সম্বরা, সুতারা ও চন্দ্রিকা নামের পাঁচ বান্ধবীই সুদর্শন তরুণ ঋষিকে প্রেম নিবেদন করে। প্রেমের ব্যাপারে পাঁচটি মেয়েই বেশ সক্রিয়, অগ্নিপকে আপন বাহুলতায় জড়িয়ে তারা প্রেম নিবেদন করে। ব্রহ্মচারী অগ্নিপ এতে মোহিত হলেন না, উল্টে তাদের পিশাচী হওয়ার অভিশাপ দিলেন। পাঁচ কন্যাও ছাড়ার পাত্র নয়, তারাও অতৃপ্ত কামনা থেকে ঋষিকে পিশাচ হওয়ার শাপ দেয়, “ভক্ত, অনুরক্ত ও মিত্রের প্রতি যে ব্যক্তি রূঢ় আচরণ করে, তাকেই পাপ স্পর্শ করে।” বহুকাল পরে পৌষ মাসের চতুর্দশী তিথিতে লোমশ মুনি সেখানে স্নান করতে আসেন, তাঁর আশীর্বাদে এই পঞ্চপিশাচী ও পিশাচ তীর্থরাজ প্রয়াগে গিয়ে স্নান সারে, আগের দেহ ফিরে পায়, অতঃপর তাঁর কথায় ঋষিকুমার পাঁচ বান্ধবীকেই স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করে।

গল্পের পাদটীকায় লেখক জানিয়েছেন, এই কাহিনিটি তিনি পদ্মপুরাণ থেকে নিয়েছেন। মহাভারতের বনপর্বে অবশ্য এই গল্পটাই অন্য ভাবে আছে। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন সৌভদ্র তীর্থে স্নানে নেমেছেন, পা কামড়ে ধরল এক কুমির। প্রবল শক্তিতে তাকে নিয়ে উঠে এলেন অর্জুন, কুমির আচমকা পরিবর্তিত হয়ে গেল সুন্দরী রমণীতে। তার পর সে জানাল, তার নাম বর্গা। কুবেরের প্রিয় নর্তকী সে। তারা পাঁচ বান্ধবী এক ঋষিকুমারকে নেচেগেয়ে প্রেম নিবেদন করেছিল। ঋষির মন দুর্বল হল না, উল্টে তাদের কুমির হওয়ার অভিশাপ দিলেন।

কুমির, না পিশাচ? কে এই মেয়েদের শাপমুক্ত করলেন? অর্জুন না লোমশ ঋষি? সৌভদ্রতীর্থেই সে পিশাচীরা মুক্তি পেল, না মাঘ মাসের প্রয়াগে স্নান করতে হল? মেয়েরা কি প্রেমের ব্যাপারেও এতটা সক্রিয় স্বেচ্ছাবাসনাকারিণী হতে পারতেন? হর্ষ দত্ত মুখ্যত গল্পলেখক, এবং এই নিবন্ধগ্রন্থেও তিনি স্বধর্মে স্থিত। কোনও তত্ত্বকথা না আওড়ে পুরাণের গল্পটা আকর্ষণীয় ভাবে বলাই তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব। আজকের যুগে সেটাই দরকার। ব্যাখ্যা বুদ্ধিমান পাঠক আপন অনুসন্ধিৎসায় খুঁজে নেবে। একই গল্প কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন পুরাণ ও মহাভারতে আসবে, যাঁর যা বিশ্বাস খুঁজে নেবেন। এখানেই ভারতীয় সভ্যতা এবং গল্পের জয়।

পৌরাণিক পঞ্চবিংশতিহর্ষ দত্ত

৮০০.০০

আনন্দ

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পদ্মপুরাণ অবলম্বনে এই গল্পে মেয়েরা কামের জয়গান করে, ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ এই চতুর্বর্গের জয়গান করে। মহাভারতে বেশির ভাগ সময় ধর্ম, অর্থ, কাম এই ত্রিবর্গের জয়গান করা হয়েছে। কখনও কখনও মোক্ষ ধর্মের। কিন্তু রোমিলা থাপর থেকে বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ আজ একমত। এই মোক্ষ শব্দটি বৌদ্ধ ধর্মের অবদান। এই গল্প জানাল, পদ্মপুরাণের মতো প্রধান পুরাণও (পদ্মপুরাণ, মৎস্যপুরাণ ইত্যাদি ১৮টি পুরাণকে প্রধান গণ্য করা হয়) সেই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়, হওয়ার কথাও ছিল না।

গল্পে দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি চমৎকার লাগল, তা প্রয়াগ তীর্থে মাঘস্নানের জন্য লোমশ ঋষির উপদেশটি। এই উপদেশ মহাভারতে থাকার কথা ছিল না, কিন্তু পুরাণে অবশ্যম্ভাবী। পুরাণবিদ রাজেন্দ্রচন্দ্র হাজরা বা আর সি হাজরাকে আধুনিক বাঙালি মনে রাখেনি, কিন্তু ১৯৪০ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেপে বেরিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত বই স্টাডিজ় ইন দ্য পুরাণিক রেকর্ডস অন হিন্দু রাইটস অ্যান্ড কাস্টমস। সেখানে তিনি পরিষ্কার জানাচ্ছেন, এক পুরাণের গল্প আর একটা পুরাণে থাকতেই পারে। কিন্তু প্রত্যেক পুরাণেই থাকবে তার মতো করে সৃষ্টিতত্ত্ব, আর কোন তিথিতে কোন তীর্থক্ষেত্রে কী করতে হয়, তার নিদান।

সম্প্রতি নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর সম্পাদনায় চার খণ্ডের যে পুরাণকোষ ছেপে বেরিয়েছে, সেখানেও এক-একটি নামের সঙ্গে রয়েছে চার-পাঁচ রকম পুরাণ থেকে নেওয়া টীকা ও অনুষঙ্গ। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। আধুনিক নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে একদা ময়ুরাক্ষী, তুমি দিলে কিংবা ছায়ার পাখি-র মতো উপন্যাস লিখেও এখানে অহেতুক তথাকথিত ‘সেকুলার’ এবং আধুনিক হওয়ার রোগে ভোগেননি। পুরাণকাহিনিটি সাবলীল ভঙ্গিতে বলাই এখানে তাঁর প্রধান উপজীব্য ছিল।

বইয়ের ২৫টি নিবন্ধের ১৩টি পুরাণ থেকে, ১২টি মহাভারত থেকে। এবং মহাভারত নিয়ে কেউ কখনও একমত হয় না। এখানে লেখকের সূত্র প্রায়শই হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের মহাভারতম্। তাতে ক্ষতি নেই। বৈদান্তিক নীলকণ্ঠের টীকাই ছিল এই মহাভারতের অবলম্বন, সেখানে অনেক চমকপ্রদ গল্প আছে। পরবর্তী কালে ভান্ডারকর ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘ক্রিটিক্যাল’ সংস্করণে আবার অনেক গল্প নেই। যেমন, বেশির ভাগ পাণ্ডুলিপিতে না থাকার দরুন ওই সংস্করণে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের গল্প নেই। রাজশেখর বসুর মতো সম্প্রতি জন ডি স্মিথ ওই ক্রিটিক্যাল এডিশনের একটি সারানুবাদ প্রকাশ করেছেন, তাতে আমাদের মতো সংস্কৃতে অনপঢ় পাঠকের অনেক সুবিধা হয়েছে। তফাতের একটা উদাহরণ দিই। অভিমন্যুর মৃত্যুর পর দ্রোণাচার্যের অস্ত্রত্যাগ করে ধ্যানে বসার গল্প লিখতে গিয়ে ‘সত্য ও অসত্য’ নিবন্ধে হর্ষ লিখছেন, বিষ্ণুর ধ্যানে নিরত হয়ে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। ক্রিটিক্যাল এডিশন অন্য কথা জানাচ্ছে, তিনি তখন যোগরত। এবং সেই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করলে তিনি ব্রহ্মলোকে গমন করেন। বিষ্ণুর ব্যাপার নেই। ইতিহাসবিদদের ধারণা, এই বিষ্ণুভক্তি ভার্গব প্রক্ষেপ। ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণদের হস্তক্ষেপ!

লেখক অবশ্য গল্পের টানে ব্রহ্মা, মহেশ্বর নন, বিষ্ণুরই শরণাপন্ন। ‘ক্ষমা সর্বত্র সর্বদা’ প্রবন্ধে তক্ষক নাগের দংশনে অভিমন্যুপুত্র পরীক্ষিৎ-এর মৃত্যুর গল্প বলতে গিয়ে লিখছেন, “মৃত্যু আসন্ন জেনে অনুতপ্ত পরীক্ষিৎ জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ শুকদেবের মুখে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করেছিলেন।” ক্রিটিক্যাল এডিশন হরিবংশ-কেই মহাভারতের মধ্যে রাখেনি, সংযোজিকা হিসাবে পরের খণ্ডে রেখেছে। শ্রীমদ্‌ভাগবত তারও পরে। সম্প্রতি বিবেক দেবরায় ক্রিটিক্যাল এডিশনের যে অনুবাদ প্রকাশ করেছেন, সেখানেও এই নীতি অনুসৃত।

কিন্তু মহাভারতের কথা বলতে গিয়ে শেষে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নৃত্যনাট্যের বজ্রসেন কেন? ওর সঙ্গে মহাভারতের সম্পর্ক নেই, ওটি রাজেন্দ্রলাল মিত্র সংগৃহীত বৌদ্ধ গল্প থেকে নেওয়া। একই নিবন্ধে ‘মর্মানুতাপ’ শব্দটিও চোখে পড়ল। মর্মমাঝারে ও সব অনুতাপ-টনুতাপ খ্রিস্টীয় ধারণা, মহাভারতের সঙ্গে সম্পর্করহিত। ‘সত্য ও অসত্য’ নিবন্ধে একটি লাইন বড় পীড়াদায়ক। “কামপ্রবৃত্তি সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে পতিতা-সংসর্গ সর্বযুগেই নিন্দনীয়।” তা হলে অপ্সরাদের স্বর্গবেশ্যা বলা হত কেন? বাৎস্যায়নের কামসূত্র-ই বা কী হবে? কিংবা মৃচ্ছকটিক নাটকের বসন্তসেনা?

আবার বলি, এগুলির কোনওটাই আসলে অপরাধ নয়। বহুমতের তর্ক। স্বয়ং শঙ্করাচার্যও এই বহু মত, বহু ভাষ্যের কথা জানতেন। ফলে তিনি বলছেন, পুরাণের বয়ান নিয়ে সংশয় হলে মহাভারত দেখো। ওটি একই সঙ্গে ইতিহাস ও পুরাণ। তাতেও সংশয় না মিটলে পরে সর্বোচ্চ রায়ের জন্য বেদ ঘাঁটতে হবে।

লেখক বেদের কাহিনি লেখেননি। তিনি অনায়াস ক্ষমতায় পুরাণ ও মহাভারতের কয়েকটি গল্প, কোনও তত্ত্ব এবং সংশয় ব্যতিরেকে লিপিবদ্ধ করেছেন। বাংলা বাজারে এটি কম কৃতিত্ব নয়!

গৌতম চক্রবর্তী

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review Mahabharata

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy