Advertisement
০৪ জুন ২০২৪
Book Review

স্মৃতিগর্ভ, কিন্তু স্মৃতিসর্বস্ব নয়

এই কলম স্মৃতিকে জাগালেও নস্ট্যালজিয়ায় ভোগে না, আর্দ্র স্মৃতিকাতরতা তার উদ্দেশ্য বা বিধেয় নয়। তিনি শুরু করেন বাস্তবের মাটি থেকে।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:০৯
Share: Save:

এক জন লেখক নাকি একটাই বই লিখে চলেন জীবনভর, এমন আপ্তবাক্য প্রচলিত আছে সাহিত্যের দর্শনে। ছাপার আলো-দেখা নানা বইয়ের মধ্যে সেই বইটা থাকতে পারে কিছু কিছু— সঙ্কেতে অনুষঙ্গে ইশারায়— কিন্তু থাকবেই যে তা নয়। বরং না থাকারই কথা বেশি, যাপনের সত্য আর শিল্পের সত্যের ‘ফারাক’ এক-একটা বই, ছবি, সিনেমা, মোট কথা শিল্পবস্তুকে করে রাখে রচয়িতার অধরা। লেখক বা শিল্পী তাই নিয়তিতাড়িতের মতো খুঁজে ও খুঁড়ে চলেন ব্যক্তি ও সমষ্টিমানুষের প্রত্নস্মৃতি। সেই স্মৃতিই তাঁর মিউজ়িয়ম। সেখানে নানা আশ্চর্য প্রদর্শ থেকে পথ-দেখানিয়া আলো ঠিকরে বেরোয়, এক-একটি অনুষঙ্গ স্পর্শ করে মেলে থরথর সুখ, ভাবনা ও কল্পনার ডানা দীর্ঘ উড়ানের পর জিরোতে পারে প্রাগিতিহাসের মাটিতেও।

স্মৃতি নামের সেই মিউজ়িয়মের আজব কুদরতই পরিমল ভট্টাচার্যের এই গদ্যগ্রন্থের উপজীব্য। তাঁর লেখাপত্তরে স্মৃতি ও অতীতের প্রত্নসন্ধান এক অমোঘ চুম্বক, তা সে দার্জিলিং নিয়ে লেখা হোক বা ওড়িশা, অপুর দেশ অথবা শাংগ্রিলার হিমালয়, ডোডোপাখিদের গান কিংবা ড্যাঞ্চিনামা। তবে তফাত আছে। এই কলম স্মৃতিকে জাগালেও নস্ট্যালজিয়ায় ভোগে না, আর্দ্র স্মৃতিকাতরতা তার উদ্দেশ্য বা বিধেয় নয়। তিনি শুরু করেন বাস্তবের মাটি থেকে। তাঁর উড়ালবিন্দু কোচির এক সত্যি-মিউজ়িয়মে হলঘরের উঁচু ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা ডোঙা— দু’হাজার বছর আগের মানুষ যা বানিয়েছিল গাছের কাণ্ড কুঁদে— কিংবা ১৮৯৬ খানা খোলামকুচি জুড়ে জুড়ে গড়া প্রাচীন রোমক মৃৎপাত্র। কিংবা ভীমবেটকার গুহার দেওয়ালে হাজার হাজার বছর আগে আঁকা একলা-কুকুরের ছবি। এই ছবিই তাঁকে দিয়ে এক লপ্তে লিখিয়ে নেয় ছোটবেলায় কুড়িয়ে পাওয়া কুকুরছানা ‘ভুক’-এর জীবনকাহিনি, পাড়ায় আসা রাশিয়ার সার্কাসের স্মৃতিও কারণ তারই সঙ্গে আশ্লিষ্ট ভুকের অন্তিমপর্ব, এবং ওই রাশিয়াসূত্রেই এসে পড়ে রুশ কুকুর ‘লাইকা’, মানুষের প্রয়োজনে অজানতেই যাকে বলি দেওয়া হয়েছিল মহাকাশে— তার কথা।

নাহুমের গ্রাম ও অন্যান্য মিউজিয়াম

পরিমল ভট্টাচার্য

৩০০.০০

অবভাস

একটা চিত্রকল্প বা ইমেজ, তা থেকে একটা স্মৃতি, তারও সঙ্গে পরিবার-পাড়া-সমাজ-দেশ বা বৃহত্তর আন্তর্জাতিকতায় ঘটে-যাওয়া কোনও ঘটনা— ‘ন্যারেটিভ’-এর চলনে এই সব কিছুকে অবলীলায় মিশিয়ে নেওয়াটা এই গদ্যের গুণ। স্মৃতিগদ্য হয়েও যা কদাচ প্যাচপেচে নয়, শুধুই ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’— নয়। বস্তুত এই বই স্মৃতিগর্ভ হয়েও স্মৃতিসর্বস্ব নয়, ইতিহাস থেকে নৃবিজ্ঞান, গ্রন্থচর্চা, শিল্প-অভিজ্ঞতার নানা প্রকোষ্ঠে তার ক্রমাগত গতায়াত। সমরেশ বসুর মতো লেখক কী ভাবে এক জনপদকে বিখ্যাত ও অমর করে দেন তাঁর লেখায়, অন্যে যেখানে সেই বহুচর্চিত ‘ক্লিশে’ খুঁজে ফিরবে, গ্রন্থকার সেখানে লেখেন বিপ্রতীপ বয়ান: ইতিহাসবিশ্রুত এক জনপদ কী ভাবে এক লেখকের নির্মাণ ও বিনির্মাণ ঘটাচ্ছে।

স্মৃতিধার্য সময়কে তুলে ধরার এই যাত্রায় খানিক প্রাগল্‌ভ্যও সঙ্গী হয় কখনও, যেমন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একশো বছরের নিঃসঙ্গতা উপন্যাসের সঙ্গে লেখকের একান্ত নিজস্ব সহবাসে; বার্গম্যানের ছবির সূত্রে আশির দশকে আর্টহাউস সিনেমাকে বুকে চেপে ধরা কলকাতার চিত্রণে, বা সুদূর জার্মানিতে শেষশয্যায় তারকোভস্কির না-লেখা এক পথের পাঁচালী-র চিত্রনাট্য কল্পনায়। ভাব ও ভাষার পরিণয়ে সেও এক প্রগাঢ় সুখপাঠ। জীবনের কূপমণ্ডূকতা আড়াল করতে অতীতজীবিতাই যখন হয়ে উঠছে বাঙালির শেষ খড়কুটো, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই বই হতে পারে উদাহরণ— অতীতকে লতিয়ে কেমন করে বেড়ে উঠবে ভবিষ্যতের মনন-সম্ভাবনা।

লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ সরাসরি: মেয়েদের ভোট বিশ্লেষণ এবং তর্ক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE