Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

পড়াশোনা শুরু হোক এখান থেকে

প্রকৃতিকে কী ভাবে পড়তে হয় জীবন সর্দার তার পাঠ দিয়েছেন এই বাংলার নানা কোণে, গ্রামে-গঞ্জে সৈকতে-নদীপাড়ে তাদের নিয়ে গিয়ে। এই বইয়ের শেষাংশে আছে সেই পাঠশালার পড়ুয়াদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা, তাদেরই কলমে।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর
জীবন সর্দার
৬০০.০০
৯ঋকাল বুকস

প্রকৃতি। বিশুদ্ধ বিশাল স্পন্দিত প্রকৃতি। কোথায় সে থাকে? থাকে আমাদের মনে। মনস্তত্ত্বজিজ্ঞাসু অধ্যাপকের (পিটার কান, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়) প্রত্যয় জন্মেছে যে, প্রতিটা প্রজন্ম যে-পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেটাই তার কাছে ‘বিশুদ্ধ প্রকৃতি’, তা সে যত রিক্ত, যত কলুষিতই হোক না কেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিশুদ্ধ প্রকৃতি সংক্রান্ত ধারণাটার এই ভাবে ক্রমশ মুছে যেতে থাকাকে তিনি বলছেন এক ধরনের স্মৃতিলোপ, বলছেন, এটা ‘এনভায়রনমেন্টাল জেনারেশনাল অ্যামনেসিয়া’। তাঁর মতে, কাকে বলব অকলুষিত প্রকৃতি তার সংজ্ঞাটা অবিরত বদলায়, ফলে প্রকৃতি যে আর প্রকৃতিস্থ নেই সেই বোধটাই জন্মাতে পারে না আর। অথচ উল্টো দিকে মনস্তত্ত্ব-গবেষকদের কাছেই ক্রমে আরও বেশি করে ধরা পড়ছে, একজন প্রাপ্তবয়স্কের মানসিক স্বাস্থ্য, চারিত্রিক দার্ঢ্য অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছে তার বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে বিশুদ্ধ প্রকৃতির সাহচর্যের মাত্রার সঙ্গে।

এটাই যদি বার্তা, তবে আর কী করার থাকে আমাদের? বিস্মৃতিদানবকে ঠেকানোর কোনও উপায় কি আছে? আছে। ইন্টারঅ্যাক্ট। মনে করাচ্ছেন অধ্যাপক কান। কেবল প্রকৃতির সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্ঞান উদ্‌গিরণ করে লাভ হবে না।

প্রকৃতিকে ছুঁয়ে-ছেনে নেড়ে-ঘেঁটে দেখার, অকারণেই তার গায়ে পড়ার, আলাদা করে দরকার যে আছে, সে কথাটা নতুন নয়। ‘ব্যাঙের খাঁটি কথাটি’ লিখতে না পারার আক্ষেপ আমাদেরই কবির। ‘ছেলেটা’র অবরুদ্ধ কৈশোরকে হয়তো আমরাও ভুলিনি, কিন্তু তার সঙ্গে বাদবাকি সব কিছুকে কেবল সাহিত্যিক অতিরেক আর সৃজনের আনুষঙ্গিক উপাদান বলে সাপটে ঝেড়ে ফেলেছি। তাই ‘কী আছে দেখিই-না’ এই লোভ আজ স্বাগত নয়। বাবা-মা বলেন, ও সব করে কী হবে, মন দিয়ে পড়াশোনা করো। মাস্টার ঠুসে দেওয়া হয় আরও বেশি করে। এবং বিস্মৃতি গভীর হয়।

তা হলে নেড়ে-ঘেঁটে দেখার কী হবে? আজকের নাগরিক শৈশব-কৈশোর প্রকৃতি থেকে— ধরা যাক তার আগের ও তস্য আগের প্রজন্মের ধারণায় গাঁথা বিশুদ্ধ প্রকৃতি থেকে, এত দূরে গিয়ে পড়েছে যে, আজ সেই অপরিচয়ের গণ্ডি কাটানোটাও একটা অসামান্য কাজ। এরই মধ্যে, যেন আচমকা ধর্মতলা-কাঁপানো ‘মিনি-মিনি বাস-বাস’ হইহট্টগোলের মাঝখানে ফুটপাত ফুঁড়ে লাফিয়ে ওঠা কিংকর্তব্যবিমূঢ় শুশুকের মতো দেখা গেল এক বই, প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর।

‘‘মানিকদা বললেন, ‘নেচার নিয়ে একটা বিভাগ করো। তার ভাষা ও বিষয় তুমিই ঠিক করবে।’’ অবশ্যই ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। কবি অলোকরঞ্জন বললেন, ‘‘মুগ্ধ পাঠক হয়ে থেকো না, দেখা জিনিস লিখে দাও। সুভাষদা এমন লেখাই চাইছেন।’’ সত্যজিৎ রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের চিন্তা রূপ পেল জীবন সর্দারের কলমে (আলোচ্য বইয়ে কোনও অজ্ঞাত কারণে প্রকৃত নামটি ঊহ্য রাখা হয়েছে)। ‘প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর’ নামটি অলোকরঞ্জনের দেওয়া, প্রথম দিকে জীবন সর্দারের লেখার ভাষা মেরামত করে তার সুর গেঁথে দিতেন অলোকরঞ্জনই। এই ভাবে যে-বিভাগের সূচনা হল তা চলল টানা চার দশক। তবে, শেষ অবধি এটা কেবলই একটা পত্রিকার বিভাগ হয়ে থাকেনি, ‘সন্দেশ’-এর কচি-কাঁচা পাঠক-পাঠিকাদের নিয়ে চালু হয়েছিল ‘প্রকৃতি পড়ুয়ার পাঠশালা’। প্রকৃতিকে কী ভাবে পড়তে হয় জীবন সর্দার তার পাঠ দিয়েছেন এই বাংলার নানা কোণে, গ্রামে-গঞ্জে সৈকতে-নদীপাড়ে তাদের নিয়ে গিয়ে। এই বইয়ের শেষাংশে আছে সেই পাঠশালার পড়ুয়াদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা, তাদেরই কলমে।

পত্রিকায় প্রকাশের সময় একাধিক প্রজন্মকে লেখাগুলি প্রভাবিত করেছিল, আজ, দুই মলাটের মাঝখানে দেখার পর মনে হচ্ছে এটা এমন এক সম্পদ যার উপযোগিতা বিপুল, যদি সঠিক চিন্তা নিয়ে তাকে ব্যবহার করা যায়; স্থান-কাল গুলিয়ে ফুটপাতে লম্ফনোদ্যত শুশুক বলে তাকে তখন আর মনে হবে না। যেমন, রাজ্যের মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ২০১৪ থেকে স্কুলপাঠ্য বইয়ে একটা ছাপ রাখতে চেয়েছে যাতে শিক্ষার্থী তার ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে পারিপার্শ্বিক থেকে পাওয়া জ্ঞানকে ক্রমশ প্রণালীবদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়। চমকে উঠে দেখলাম এটাই তো ঠিক সেই ধারণা, কত দিন আগের, আরও বেশি সুচারু অথচ অবহেলায় ধুলোয় পড়ে ছিল। প্রতিটি স্কুলশিক্ষার্থীর ‘পড়াশোনা’ শুরু হতে পারে এই বই থেকেই।

একটা সামান্য চোখে দেখা অভিজ্ঞতা নিংড়ে তা থেকে পাওয়া তথ্যকে কী ভাবে জ্ঞানের বিভিন্ন ধারায় বইয়ে দেওয়া যায় তার শিক্ষণীয় নমুনা মিলবে এই সব রচনায়। বইটাতে বিষয়ের সাযুজ্য মেনে লেখাগুলোকে সাজিয়ে ভাল কাজ হয়েছে। অপ্রাণ প্রকৃতি, মহাকাশ, আবহাওয়া, মাটি, জল, সমুদ্র, পর্বত থেকে ক্রমশ উদ্ভিদ, পতঙ্গ, পাখি, সমুদ্রপ্রাণ ইত্যাদি জীবনের নানা আঙিনায় বিচরণ করেছে লেখাগুলো। বিষয়ের বৈচিত্র অনেক। আছে বিজ্ঞান-প্রকৃতি-পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে অনেক রচনা।

এমনিতে ওপর ওপর পড়ে গেলে এ বই বাংলার তথা এ দেশের নানা কোণের সজীব প্রকৃতির সুপাঠ্য বিবরণ। বেশ কয়েকটি লেখা পেরিয়ে এলে স্পষ্ট হয় দুটো বৈশিষ্ট্য। এক, খুব মৃদু ভাবে, এবং জোরালো নির্দেশের মতো বা মাস্টারি হুকুমের মতো না শোনায় সে দিকে খেয়াল রেখে, ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে কী দেখব, কী ভাবে দেখব-র সঙ্গে কী ভাবে ভাবব তার সুলুক। প্রকৃতি যদি একটা খোলা বই হয়, এক অশেষ বই, তবে তাকে পড়তে গেলে যে-প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞানটুকু দরকার সেটা শিখিয়ে দেওয়াই এর মূল কাজ।

দ্বিতীয়, এ বইয়ের ভাষা। বাক্যের চলন। অনুচ্চকিত, নির্ভার, সচেতন ভাবে মোলায়েম করে তোলা পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তি। যে-কোনও পৃষ্ঠা খুলুন: ‘‘আমার ছায়া ছিল ঠিক পায়ের নীচে। আমারই। ঠিক দুপুরে, ধু-ধু মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে, আর কোনও ছায়া খুঁজে পেলাম না। গরম কালের ভোরবেলায় হাঁটা শুরু করেছিলাম। হাওয়া দিচ্ছিল তখন। আরামের। ভোরের আলোয় আমার লম্বা ছায়া, দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, গুটিয়ে গেছে। তেতে উঠেছে মাটি। এখন খেয়াল হল।’’ যাকে মনে হচ্ছে সরল পরিবেশ বর্ণনা, তার ছত্রে ছত্রে পা রেখেছে এক-একটা ইন্দ্রিয়, তার অনুভব। সূর্যের চলন, ঋতুর চক্কর, পৃথিবীর মুখশ্রী। গোটা বইয়ে সচেতন ভাবে এড়ানো হয়েছে টেক্সটবুক-গন্ধী জটিল বৈজ্ঞানিক ছাঁদ। পড়লে বোঝা যায়, সে জন্য রীতিমতো পরিশ্রম করতে হয়েছে। পর্যবেক্ষণের আনুষঙ্গিক বস্তু উপকরণের ওপর একেবারে জোর দেওয়া হয়নি। উন্মুক্ত প্রকৃতি আর কেবল নিজেকে নিয়ে উপস্থিত এক জিজ্ঞাসু মস্তিষ্ক, এটুকুই প্রাথমিক চাহিদা। বাকি যা কিছু সব বাহুল্য।

সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় (যাঃ, নামটা বলে ফেললাম!) জীবনের চার-কুড়ি বছর পেরিয়ে এসেছেন বেশ কিছু আগে। এখনও প্রকৃতিচর্চায় সক্রিয়। এই বইটি যে-ভাবনার উত্তরাধিকার বহন করে আসছে তাকে যদি আমরা সুযোগ পেলেই আমাদের সাংস্কৃতিক আইডেনটিটি জাহির করার কাজে লাগিয়ে থাকি, তবে এই বইটিরও যোগ্য সমাদর হওয়া দরকার। প্রকাশককে ধন্যবাদ নিছক বইটি প্রকাশের জন্য নয়, তার মুদ্রণসৌকর্য আর অঙ্গসৌষ্ঠবের দিকে সযত্ন দৃষ্টি দেওয়ার জন্যও। বইটি সাদায়-কালোয় সুচিত্রিত, যুধাজিৎ সেনগুপ্ত তাঁর সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। বইটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই চোখের আরাম হয়। যদিও শেষ অবধি ধরা পড়ে, চিত্রগুলো বইয়ের বিশেষ কোনও রচনার সঙ্গে খুব একটা আত্মীয়তা দাবি করতে পারছে না, তবু পাঠককে তা টানে। যে হেতু এটি পূর্বপ্রকাশিত রচনার সঙ্কলন, তাই প্রতিটির প্রথম প্রকাশকাল উল্লেখ করা দরকার ছিল।

যুধাজিৎ দাশগুপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Books Book Review Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE