Advertisement
E-Paper

Book review: ‘অরাজনৈতিক’ পল্লি-উন্নয়ন ব্রত

রথীন্দ্রনাথ, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, নগেন্দ্রনাথকে কবি আমেরিকায় পাঠান আধুনিক কৃষিবিদ্যা-গোপালনবিদ্যা অর্জনের জন্য।

অভ্র ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২২ ০৭:১৭
হাতে-কলমে: শ্রীনিকেতনে বই-বাঁধাইয়ের ক্লাসে পড়ুয়ারা। ছবি বই থেকে নেওয়া

হাতে-কলমে: শ্রীনিকেতনে বই-বাঁধাইয়ের ক্লাসে পড়ুয়ারা। ছবি বই থেকে নেওয়া

১৯২২ সালে বিশ্বভারতীর গভর্নিং বডিতে যোগ দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ যদুনাথ সরকারকে আমন্ত্রণ জানালে স্যর যদুনাথ তা প্রত্যাখ্যান করে এক ‘নিষ্ঠুর’ চিঠি লেখেন। তাতে ছিল: “যেমন বৈষ্ণবেরা ভক্তিবিগলিত অশ্রু হইয়া সব জিনিষ অস্পষ্ট দেখে, তেমনি বোলপুরের ছাত্রগণ শেখে ভাবের (emotion) বাষ্পের আবরণ দিয়া জগতের দিকে তাকাইতে।” তাঁর অভিযোগ, বোলপুরের ছাত্রদের ‘একজ়্যাক্ট নলেজ’ ও ‘ইনটেলেকচুয়াল ডিসিপ্লিন’-কে ঘৃণা করতে শেখানো হয়। ‘সায়েন্টিফিক’ বিদ্যার অভাব আছে। ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ উত্তরে জানান, “...বৈজ্ঞানিকতাকে আমি যেমন মানি ভাবুকতাকেও তেমনি মানি। আশ্রমের বায়ুতে সেই ভাবুকতার উপাদান যদি কিছু থাকে তবে সেটা কি চিত্তবিকাশের পক্ষে হানিকর? সেই সঙ্গে আরও কিছু কি নাই? এখানে যে কৃষিবিভাগ খোলা হইয়াছে তাহা যদি কাছে আসিয়া দেখিতেন তবে দেখিতে পাইতেন যে তাহা যেমন বৈজ্ঞানিক তেমনি কার্য্যোপযোগী, তাহার কার্য্যক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রণালী বহুব্যাপক।”

উমা দাশগুপ্তের শ্রীনিকেতনের ইতিহাস বইটি আমরা হাতে পেলাম শ্রীনিকেতনের শতবর্ষে। ভূমিকা অধ্যায়ে তিনি জানিয়েছেন, শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের ইতিহাস বুঝতে ‘বায়োগ্রাফিক্যাল হিস্ট্রি অব রবীন্দ্রনাথ’স ক্লোজ় এনগেজমেন্ট উইথ ভিলেজ রিফর্মস’-এর কথাও জানতে হবে। সুতরাং ১৮৯০-এর যুগ থেকে শিলাইদহ-পতিসরে কবির পল্লি-পুনর্গঠনের ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বাংলার দুঃস্থ পল্লির চিত্র দেখে তাঁর মনে হয়, শুধু দারিদ্র নয়, নিরানন্দ মানুষের জীবন মনুষ্যত্বের অবমাননা ঘটাচ্ছে। পল্লি-উন্নয়নের ব্রতে অর্থনৈতিক সংস্কার ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মিলন চাই। চাই ভিন্ন শৈলীর এক গঠনের ব্রত ও আধুনিকতা। যে আধুনিকতা মানবিকতার কথা বলে, তপস্যার সঙ্গে আনন্দের মিলন ঘটায়। ‌শিলাইদহ অভিজ্ঞতা কাজে লাগে ১৯২২ সালে এল্‌মহার্স্টের সহায়তায় সুরুলে বিশ্বভারতীর এগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্ট তৈরির সময়। উমা দাশগুপ্তের মতে, ১৯২৪ সালে শ্রীনিকেতন নামে এই বিভাগ পরিচিত হল। প্রশান্তকুমার পাল অবশ্য জানান: ১৯২৩ সাল। প্রথম অধ্যায়ে লেখক বলেছেন রবীন্দ্রনাথের সারাজীবন-লালিত ‘আত্মশক্তি’ দর্শন, আধুনিক সার-বীজ-যন্ত্রের সাহায্যে চাষ-আবাদের ক্ষেত্রে কবির বৈজ্ঞানিক মনোভাব, ও শিলাইদহের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের কথা। এই সূত্রেই বলা দরকার, দেশের রাজনৈতিক নেতৃবর্গ ও শিক্ষিত বাঙালি সমাজের দৃষ্টি ছিল না ‘ছোটলোক’ সমাজের দিকে, অথচ ১৯০৪ সালে লিখিত ‘স্বদেশী সমাজ’-এই কবির বক্তব্য ছিল, দেশের স্বাধীনতার অর্থ— ‘স্বদেশী সমাজ’ গঠন। প্রসঙ্গত বলি, ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ধারণা বিষয়ে বহু ভ্রান্ত ধারণা— সে কালেও, এ কালেও। সুভাষচন্দ্র মনে করেছিলেন ‘স্টেট উইদিন আ স্টেট’, এ কালের হিতেন্দ্র মিত্র এর অনুবাদ করেছেন ‘ন্যাশনাল সোসাইটি’ শব্দবন্ধে। উমা দাশগুপ্ত এই ধারণাটি যথার্থ অনুধাবন করে লিখেছেন, ‘স্টেট সোসাইটি’। রবীন্দ্রনাথের মতে, ভারতবর্ষ সমাজ-প্রধান সভ্যতা, পশ্চিমের মতো রাষ্ট্রনির্ভর নয়। তাই আমাদের রাজনীতি হবে সমাজগঠন, পল্লি উন্নয়ন— রাষ্ট্রক্ষমতার পিছনে ছোটা নয়। এই অরাজনৈতিক রাজনীতির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ শ্রীনিকেতন।

রথীন্দ্রনাথ, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, নগেন্দ্রনাথকে কবি আমেরিকায় পাঠান আধুনিক কৃষিবিদ্যা-গোপালনবিদ্যা অর্জনের জন্য। শ্রীনিকেতন পর্বে এল্‌মহার্স্টের নেতৃত্বে এঁরা সহযোগী যোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন কালীমোহন ঘোষ, যিনি কবির সঙ্গে শিলাইদহে কাজ করেছিলেন। বহুমুখী শ্রীনিকেতন প্রকল্প প্রভূত ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। পরে যৎসামান্য সরকারি সাহায্য মিলেছিল, কিন্তু এল্‌মহার্স্টের বান্ধবী ডরোথি স্ট্রেট-এর বিপুল সাহায্য ব্যতিরেকে শ্রীনিকেতনের কাজ এগোত না।

কবির চিন্তায় উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত ছিল সমবায়নীতি। নিরন্ন মানুষকে পাইয়ে দেওয়া নয়, সমবায়ের ভিত্তিতে জনসমাজকে স্বাবলম্বী করে তোলা। কৃষিখামার, জলসেচ, কুটির শিল্প নির্মাণে সমবায়ই হবে একমাত্র ভিত্তি। জমিদার-মহাজনদের তরফ থেকে বাধা সত্ত্বেও ছোট চাষিদের, খেতমজুরদের সঙ্ঘবদ্ধ করে সমবায়িক কর্মকাণ্ড সফল হয় গোয়ালপাড়া, বল্লভপুর, লালদহ, বেনুরিয়া, ইসলামপুর, বাহাদুরপুর ইত্যাদি অঞ্চলগুলিতে।

গুরুত্বময় কাজ হয়েছিল স্বাস্থ্য বিষয়ে। গ্রামে হাতুড়ে ডাক্তার ছাড়া অন্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যচেতনাও ছিল না। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে ডাক্তার-বিজ্ঞানী গ্রেচেন গ্রিন, হ্যারি টিম্বার্স-সহ শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা এ কাজে ব্রতী হন। স্বাস্থ্যসমবায়ের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়— উমা দাশগুপ্ত জানিয়েছেন সুগত দাশগুপ্তের রচনা উদ্ধৃত করে।

এল্‌মহার্স্টকে চিঠিতে কবি জানান: ‘লিভিং টাচ অব ক্রিয়েটিভ ফেথ’ ছাড়া গ্রামোন্নয়ন সম্ভব নয়। কালীমোহন ঘোষ, সন্তোষ মজুমদার, গৌরগোপাল ঘোষদের মতো মানুষদের অবিচলিত হৃদয়স্পর্শে শ্রীনিকেতন সম্ভব হয়েছিল। গ্রামের মানুষ কালীমোহনকে আত্মীয়সম জ্ঞান করতেন। রবীন্দ্রনাথ ধীরানন্দ রায় ও বিনায়ক মসোজিকে জবলপুরে পাঠান স্কাউট প্রশিক্ষণের জন্য। তৈরি হয় ব্রতীবালক সঙ্ঘ। এঁরা ছড়িয়ে পড়েন বীরভূম ও সন্নিহিত জেলাগুলিতেও। ব্রতীবালকদের কর্মকাণ্ডের ইতিহাস পৃথক এক গবেষণাই দাবি করে। উমা দাশগুপ্ত জানান, নন্দলাল বসুর শিষ্য বিনায়ক মসোজি এই কাজে অগ্রসর হন পল্লির মানুষকে শিল্পকর্মে (আর্ট) উজ্জীবিত করার জন্য। শুধু বস্তুগত সম্পদ সৃষ্টি নয়, পল্লিগুলিকে শ্রীমণ্ডিত করাও ছিল অন্যতম সঙ্কল্প।

আ হিস্ট্রি অব শ্রীনিকেতন: রবীন্দ্রনাথ টেগোর’স পায়োনিয়ারিং ওয়র্ক ইন রুরাল রিকনস্ট্রাকশন

উমা দাশগুপ্ত

৪৫০.০০

নিয়োগী বুকস

তৈরি হয় শিক্ষাসত্র। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে যে শিক্ষা গড়ে তুলতে চান, সর্বাংশে তাতে সফল হননি। ভদ্রলোক অভিভাবকদের চাপে তাঁকে বহু বিষয়ে আপস করতে হয়। তাই শ্রীনিকেতনে শিক্ষা-বঞ্চিত কিশোর-কিশোরীদের জন্য গড়ে তোলেন শিক্ষাসত্র। লেখাপড়া ছাড়া সেখানে ছিল ‘সব কাজে হাত লাগাই মোরা সব কাজে’র মন্ত্র। তবে সমবায়িক আদর্শে গড়ে ওঠা শিল্পভবন শ্রীনিকেতনের সর্বোত্তম কাজ। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, সুরেন্দ্রনাথ কর, নন্দলাল বসুরা এই বিভাগের সম্প্রসারণ ঘটান। গ্রামীণ মানুষদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ছিল হরেক রকম ব্যবস্থা। কাঠের কাজ, চামড়ার কাজ, মাটির কাজ, কাপড়ের কাজ শ্রীনিকেতন প্রকল্পে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। দু’রকম বিপ্লব— কর্মসংস্থান ও শিল্পসৌকর্যের বিপ্লব। পাশাপাশি ছিল কৃষিখামার, ডেয়ারি, পোলট্রি: আঞ্চলিক শ্রমজীবীদের কর্মসংস্থানে তারও গুরুত্ব অপরিসীম।

উমা দাশগুপ্ত শ্রীনিকেতনের পৃষ্ঠপোষক লর্ড এস পি সিংহের ‌এল্‌মহার্স্টকে লেখা চিঠি উদ্ধৃত করেছেন যার মূল প্রতিপাদ্য, “আই অ্যাম অ্যাংশাস দ্যাট স্টেপস বি টেকেন ‘উইদাউট ডিলে’ টু এনশিয়োর দ্য প্রেজ়েন্স অব বিজ়নেস ট্যালেন্ট ইন দ্য কাউন্সিলস অব শ্রীনিকেতন।” এল্‌মহার্স্ট বিষয়টিকে উপেক্ষণীয় মনে করেননি। রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে এ বিষয়ে পত্রালাপ তার সাক্ষ্য। এ কথা ঠিক, বহুমুখী শ্রীনিকেতন প্রকল্পের সাংগঠনিক জটিলতা ও সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, অর্থাভাবও প্রকট হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই সমবায়িক প্রথার মাধ্যমে সমাধানের কথা ভাবতেন। কিন্তু শেষে শিল্পভবনকে পৃথক করা হল ও বাণিজ্যমুখী করে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হল। ১৯৩৪ ও পরে ১৯৩৮ সালে রথীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে এক ‘রিঅর্গানাইজ়েশন স্কিম’ দাখিল করেন। কৃষিখামার, ডেয়ারি, পোলট্রি ফার্মগুলিকে তৃতীয় কোনও পার্টির কাছে লি‌জ় দেওয়া সাব্যস্ত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, জাতনিরপেক্ষ কর্মী দল তৈরি হয় এখানে। চামড়ার কাজ কেবল মুচিরা বা তাঁতের কাজ কেবল তাঁতিরাই করতেন না। এ সব তথ্য পরিসংখ্যান-সহ পেশ করেছেন লেখক। তবে শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন ও বাণিজ্য শ্রীনিকেতনের ক্ষেত্রে সংঘাত তৈরি করে কি না, সে প্রশ্ন তোলেননি।

বইটির এক বিশেষ সম্পদ এর পরিশিষ্ট। বল্লভপুর বিষয়ে কালীমোহন ঘোষের পুস্তিকা, হাশিম আমির আলির পুস্তিকা সেখানে অন্তর্ভুক্ত। শ্রীনিকেতন সংশ্লিষ্ট অজস্র ছবিও।

Rabindranath Tagore Sriniketan book review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy