স্বাধীনতার পর বেশ কয়েক দশক পর্যন্ত বাঙালি মধ্যবিত্তের মননে ও চর্চায় জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের ঘিরে রোম্যান্সের রেশ জোরদার ছিল। এক কালে ঘরে ঘরে যে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি শোভা পেত তাঁদের মধ্যে ‘বিপ্লবী’ অরবিন্দের ছবি না থাকলেও বাঙালির মনে তাঁর সম্পর্কে যে এক বিশেষ আকর্ষণ ছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অসাধারণ প্রতিভা, জাগতিক সাফল্যের আকর্ষণ উপেক্ষা করে বিপ্লবের পথ অবলম্বন, আর তারপরই হঠাৎ সন্ন্যাসগ্রহণ— নানান গল্পকথার আবহে অরবিন্দ অনেকটাই রহস্যময় এবং কতকটা বিতর্কিত। গৌতম নিয়োগী তাঁর শ্রীঅরবিন্দ: সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন (১৮৯৩-১৯১০) গ্রন্থে ১৮৯৩ সালে কর্মসূত্রে বিদেশ থেকে বরোদায় চলে আসা থেকে শুরু করে ১৯১০ সালে পণ্ডিচেরি চলে যাওয়ার সময়সীমার মধ্যে অরবিন্দের রাজনৈতিক অবদান এবং বোধবিশ্বাসের আলোচনা করেছেন। আলোচনা মূলত বিষয়ভিত্তিক হলেও পরিচ্ছেদ সাজানোর মধ্যে একটি কালানুক্রম রক্ষার চেষ্টা রয়েছে। এই বিবৃতিতে যেমন এসেছে অনুশীলন বা আত্মোন্নতি সমিতি, যুগান্তর বা বন্দেমাতরম পত্রিকা, জাতীয় শিক্ষা বা আলিপুর বোমার মামলা, তেমনই এসেছেন বঙ্কিমচন্দ্র, রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক, যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিপিনচন্দ্র পাল— সব প্রসঙ্গই অবশ্য অরবিন্দের কর্ম ও রচনাকে কেন্দ্র করে। প্রচলিত তথ্যসূত্রের (যেমন, স্বদেশি আন্দোলন বা বাংলার বিপ্লববাদ সংক্রান্ত প্রকাশিত গ্রন্থ, বিপ্লবীদের আত্মজীবনীমূলক রচনা ইত্যাদি) বাইরে, মহাফেজখানার দলিলদস্তাবেজ এবং পণ্ডিচেরি আশ্রমের প্রকাশনা ঘেঁটে লেখক এ সময়ের মধ্যে অরবিন্দের রাজনৈতিক বিচার-বিশ্বাসের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তৎকালীন কর্মকাণ্ডে তাঁর অংশীদারিত্ব এবং ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রচলিত ভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করেছেন।
লেখকের মতে, যে ‘পূর্ণতাবাদ’ এবং ‘সমন্বয়বাদ’ পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছিল যোগী অরবিন্দের চিন্তায়, তার নিরিখেই বিচার্য তাঁর রাজনৈতিক চেতনাও। এঁর নানা উদাহরণ তিনি বিভিন্ন বিষয় প্রসঙ্গে উপস্থিত করেছেন। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্রের মূল্যায়ন করতে গিয়ে অরবিন্দ বলেন যে নতুন ভাষা সৃষ্টি থেকে পুনরুত্থানের মন্ত্র— এক সমগ্রতার চেতনাই বঙ্কিমসৃষ্ট জাতীয়তাবাদের স্বরূপ, কিংবা রাজনৈতিক পরিসরে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সমন্বিত লড়াই ছিল ব্রিটিশ শক্তিকে যথোচিত আঘাত করার একমাত্র উপায়। এ ছাড়াও, আর্থিক, সামাজিক কৌলীন্য নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসীকে আন্দোলনে শামিল করার ডাকের মধ্যেও লেখক অরবিন্দের সমন্বয়বাদকে দেখেছেন। এ সবের সূত্রে আলোচনা করেছেন ‘মডারেট’ কংগ্রেসের রাজনৈতিক পন্থা এবং সামাজিক সঙ্কীর্ণতা সম্পর্কে অরবিন্দের তীব্র বিরক্তি এবং তাঁর তোলা ‘পূর্ণ স্বাধীনতার’ দাবি— যে দাবি গ্রহণ করতে কংগ্রেসের আরও বহু বছর লেগেছিল।
এ সব ছাড়া বইটির অন্যতম উপজীব্য আত্মোন্নতি, অনুশীলন প্রভৃতি সমিতির গঠন ও মতাদর্শ, সদস্যদের সামাজিক পরিচিতি, তাদের মধ্যে বিসংবাদ, ব্যক্তিহত্যার প্রকল্পে অরবিন্দের দায়িত্ব, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা, তাঁর বিভিন্ন রাজনৈতিক অভিভাষণ এবং ‘ধর্ম’ ও ‘কর্মযোগিন’ পত্রিকায় তাঁর রচনা। অরবিন্দের উত্তরপাড়া অভিভাষণ এবং অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার দু’টি এই বইয়ের পরিশিষ্টে যোগ করা হয়েছে।