Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
book review

Book review: দুই হাতে গীতা এবং মার্ক্স

বিপ্লববাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের একটি বিশেষ ধারা প্রকাশিত, তার আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি হল  স্পষ্ট, দ্বিধাহীন এবং কঠোর ভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ।

অনুপ্রেরণা: বাংলার বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রভাব ছিল বিপুল।

অনুপ্রেরণা: বাংলার বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রভাব ছিল বিপুল।

সেমন্তী ঘোষ
সেমন্তী ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৭:৫৫
Share: Save:

বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ থেকে গণতান্ত্রিক সমাজবাদে উত্তরণ: বাংলার বিপ্লবী গোষ্ঠী শ্রীসংঘ, ১৯২২-১৯৭০
পলাশ মণ্ডল
৩৫০.০০
প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স

পরাধীন ভারতের বাংলা প্রদেশে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ বিষয়ে এখনও আমাদের অনেক কিছু জানা এবং বোঝা বাকি। এ নিয়ে লেখাপত্র, গবেষণা যে খুব কম, এমনটা বলা যাবে না, যদিও আলোচ্য বইয়ের সূচনায় এ কথা বলেছেন লেখক। বরং বলা যেতে পারে, নানা ধরনের লেখালিখি থাকা সত্ত্বেও গুণগত ভাবে ভাল মানের ইতিহাস গবেষণার অভাব রয়ে গিয়েছে এখনও। বিশেষ করে এক দিকে জাতীয়তাবাদ, এবং অন্য দিকে রাজনৈতিক চরমবাদ বা র‌্যাডিকালিজ়ম সম্পর্কিত যত নতুন তাত্ত্বিক উদ্ভাবন হয়েছে গত দুই দশকে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিপ্লববাদকে ফিরে দেখার কাজটা খুব জরুরি। কেননা বিপ্লববাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের একটি বিশেষ ধারা প্রকাশিত, তার আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি হল স্পষ্ট, দ্বিধাহীন এবং কঠোর ভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ।

আলোচ্য বইটি সেই অভাব পূরণ করতে সমর্থ, এমন হয়তো বলা যায় না— তবে বাংলার বিপ্লববাদ বিষয়ে একটা খুব প্রয়োজনীয় ছবি তৈরি করতে পারে, বিভিন্ন কম-আলোচিত দিকে আলো ফেলতে পারে। সেই দিক দিয়ে এই বইটি বিশিষ্ট বলতেই হবে। এর অনেকগুলি সূত্র পরবর্তী পর্যায়ের গবেষকদের সাহায্যে লাগবে, বিপ্লবীদের ভাবনাজগৎকে বুঝতে সাহায্য করবে।

যেমন, লেখক ব্যাখ্যা করেন কী ভাবে উনিশশো ত্রিশের দশকে মার্ক্সবাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার বিপ্লববাদীদের মধ্যে নানা রকম পরিবর্তন ঘটছিল। কেউ সরাসরি কড়া মার্ক্সবাদী দর্শনে অভিষিক্ত হচ্ছিলেন, কেউ আবার গণতান্ত্রিক সমাজবাদের পথে উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলেন, আবার অনেকেই মার্ক্সবাদ-বিরোধিতার পথ গ্রহণ করেছিলেন। এই বইয়ে মূল আলোচ্য বিপ্লবী গোষ্ঠী শ্রীসংঘ, যে সংগঠন বেশ ব্যতিক্রমী— তীব্র মার্ক্সবাদ বিরোধিতার জন্য পরিচিত। শ্রীসংঘ গোষ্ঠীর আলোচনার সূত্রে বিপ্লবী আন্দোলনের সব কয়েকটি ধারার উপরেই আলোকপাত করেছেন গবেষক। এবং বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্য ধারাগুলির আদানপ্রদানের বিশ্লেষণও করেছেন।

এই বই কোনও তাত্ত্বিক আলোচনার প্রয়াস করে না, যদিও এর আলোচনার পরিসর ও তথ্য উদ্ধার থেকে আবশ্যিক ভাবে বেরিয়ে আসে নানা তত্ত্বগত প্রশ্ন। গীতা পাঠ করে যাঁরা বিপ্লববাদে দীক্ষা নিতেন, তাঁরা যখন সমাজতন্ত্রী কিংবা মার্ক্সবাদী হিসাবে নিজেদের পুনরভিষিক্ত করেন, ইতিহাসের কোন পাঠ তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে? এ কি একই আদর্শের অভিমুখে আলাদা পথ ধরে যাত্রা? না কি একই সহিংস মতবাদের পথ ধরেই দুই অসম্ভব বিপরীতধর্মী দুই আদর্শের একত্র আসা? সহিংস পথ পরিহার না করেই কিছু নৈতিক ও রাজনৈতিক রেখাপথ পাল্টে একটা ভিন্ন আদর্শের দিকে যেতে চাওয়া? ইউরোপীয় সমাজতন্ত্র থেকে এমনিতেই উপনিবেশের মতাদর্শের পার্থক্য ছিল। মার্ক্সবাদ ও বিপ্লববাদের সংঘাত ও সংযোগ কি সেই দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল?

অবশ্যই এই প্রসঙ্গে আসে সুভাষচন্দ্র আর গাঁধীর ভূমিকার কথা। লেখক দক্ষতার সঙ্গে দেখিয়েছেন, কী ভাবে বাংলার প্রাক্তন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে দুই জনেরই প্রভাব ছিল গভীর। মনে রাখতে হবে, তাঁরা দুই জনেই সামাজিক সাম্যের কথা বললেও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাস রাখেননি। তাই মার্ক্সবাদ, গাঁধীবাদ আর বিপ্লববাদের এই পাশাপাশি প্রবাহ না বুঝলে হয়তো ভারতের পরবর্তী কালের সমাজতন্ত্রী ও মার্ক্সবাদী রাজনীতির রূপ ও ক্রমবিকাশ ঠিক করে বোঝা যায় না। স্বাভাবিক ভাবেই, এই সব সম্মিলিত আদর্শের প্রভাবে, ভারতীয় মার্ক্সবাদ গণতান্ত্রিক কাঠামোতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য একটা বিশেষ নমনীয়তার অধিকারী হল। লেখক একে ‘জগাখিচুড়ি রাজনীতি’ বলেছেন। প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টির মধ্যেকার টানাপড়েন বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করে দেখিয়েছেন, ক্রমাগত স্ববিরোধিতা কী ভাবে একে সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল করেছিল। প্রশ্ন হল— কোনও বিশেষ সংগঠনকে দুর্বল করলেও এই বহুধারাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক ছত্রছায়া কি আবার অন্য এক দিক দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কৌশল হিসাবেও বেশ কার্যকর হয়নি?

স্বাধীনতা-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতির আলোচনা বইটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এবং সেই কারণেই এত রকম প্রশ্ন উঠে আসে। একটা কথা বলতেই হয়। গবেষণার ক্ষেত্রে প্রায় সব ক্ষেত্রে অভ্রান্ত ভাবে ১৯৪৭ সালকে গবেষণা পরিসরের স্বাভাবিক প্রবেশবিন্দু কিংবা অন্তবিন্দু ভাবা হয়। অথচ স্বাধীনতার মুহূর্তটি নেহাতই আপতিক, বহু দিক থেকে ভারতীয় বাস্তব ১৯৪৭-এর আগে ও পরে ছিল অপরিবর্তিত, কিংবা সময়ের সঙ্গে স্বাভাবিক গতিতেই পরিবর্তিত হচ্ছিল। তাই স্বাধীনতার বছরটি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অতখানি গুরুত্ব পেতে পারে কি না, গবেষকদের ভেবে দেখা উচিত। খুব কম বইতে ১৯৪৭ সালের দুই দিকই সমান গুরুত্বে আলোচিত হয়। এই বই সেই ব্যতিক্রমের একটি। প্রাক্-১৯৪৭ ধারাগুলির সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস এবং কংগ্রেসবিরোধী রাজনীতির বিরাট ছকের মধ্যে সমাজতন্ত্রীদের অবস্থান ও কার্যক্রম যে ভাবে ধরা পড়েছে এখানে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে উৎসাহী পাঠকের পক্ষে তা একটি জরুরি পাঠ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE