Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নাস্তিক-আস্তিক দ্বন্দ্বে মহাকাব্য

দার্শনিক প্রস্থানগুলির বিশ্লেষণে ও আস্তিকদের হাতে নাস্তিক মত খণ্ডনের নিজস্ব প্রতিপাদ্যে সমাজ বদলের ইশারাই ধরা পড়েছে।

শরণ: কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ ও অর্জুন।

শরণ: কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ ও অর্জুন। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।

ঈপ্সিতা হালদার
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২১ ০৫:৫৩
Share: Save:

মহাভারতে নাস্তিকতা
শামিম আহমেদ
৩০০.০০
আনন্দ

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে জ্ঞাতি, গুরু ও গুরুজনকে নিধন করতে হবে বুঝে অর্জুন যখন করুণাবিষ্ট, শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁকে নিষ্কাম কর্মের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে প্রথমেই বাছা বাছা ভর্ৎসনা করেন। অর্জুন অক্ষত্রিয় আচরণ করছেন, এই বলে নাস্তিক, অনার্য এই রকম কটু শব্দ অর্জুনের জন্য বরাদ্দ করেন কৃষ্ণ। যুদ্ধ-শেষে অনুশাসন পর্বে এত স্বজনবধে অনুশোচনাগ্রস্ত যুধিষ্ঠির সব ছেড়ে প্রব্রজ্যা নিতে চাইলে সমবেত ভাইরা তাঁকে ক্লীব, নপুংসক বলতেও
ছাড়েন না।

পাণ্ডবভাইদের বচনে প্রব্রজ্যার প্রতি যে তীব্র বীতরাগ, তাতে আস্তিক দর্শনবাদীদের নাস্তিক শ্রামণিক দর্শন ও চর্যা উভয়ের প্রতিই অস্বীকৃতির নজির মেলে। কথোপকথনের নৈতিকতা ও নৈতিকতা হিসেবে কথোপকথন ইতিমধ্যেই মহাভারত গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শামিম আহমেদ তাঁর গভীর গবেষণাঋদ্ধ আলোচ্য বইটিতে মহাভারতের বিপুল পরিসরে বর্ণিত কথোপকথন ও বাদানুবাদকে ভারতীয় দর্শনের আস্তিক ও নাস্তিক ধারার মধ্যে দ্বন্দ্বের একটি দলিল হিসেবে দেখেছেন। তবে, শামিমের প্রেক্ষিত দর্শনের সমাজবৈজ্ঞানিক আলোচনা নয়। বরং মহাভারতের নানা পরিস্থিতিতে কী ভাবে ভারতীয় দার্শনিক তত্ত্বপ্রস্থানগুলি আলোচনা হয়েছে, এবং কী ভাবে নাস্তিক দর্শনকে পূর্বপক্ষ ধরে আস্তিক দর্শন নিজে সিদ্ধান্তী হিসেবে নাস্তিকতার যুক্তিগুলি খণ্ডন করেছে, শামিম মহাভারতের নিবিষ্ট পাঠের মধ্যে দিয়ে তা দেখান। শামিম এই প্রক্ষেপণকে বিশেষ ভাবে দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট পর্বগুলি, যেমন শান্তিপর্বের মোক্ষধর্ম পর্বাধ্যায়ে ভীষ্মের আধ্যাত্মিক জবানিতেই শুধু দেখিয়েছেন তা নয়, নানা ধরনের বচনে-বাচনে, আখ্যানের মোড়ে, সম্বোধনে তিনি খুঁজে বার করেছেন নাস্তিক মত ও মতাবলম্বীদের উপস্থিতি, এবং বলেছেন মহাভারতের বহুস্বরতার স্তরে স্তরে কী ভাবে নাস্তিক দর্শন প্রস্থানের খণ্ডনের মধ্যে দিয়ে প্রাধান্য লাভ করে আস্তিক্যবাদী। নাস্তিকদের সরাসরি নিপীড়নের ছবিও শামিম খুঁজে বার করেছেন।

কারা এই নাস্তিক? যাঁদের পাষণ্ড, মূর্খ, কটুভাষী ও কুকুরের ন্যায় বলা হয়েছে মহাভারতে? শামিম দেখিয়েছেন, মহাভারতের বৃহৎ ও বহুরৈখিক পরিসরে সাতটি নাস্তিক দার্শনিক চিন্তাকে খণ্ডন করা হয়েছে। আন্বীক্ষিকী, চার্বাক, বৌদ্ধ বা সৌগত, বৈশেষিক, জৈন, তৈর্থিক ও উড়ুলোম দর্শন— এই সাতটি দর্শনের সঙ্গে আস্তিক বা ব্রহ্মবাদীদের তর্কপ্রকরণগুলি বিবেচনা করে শামিম বলেছেন যে, অন্যান্য ধর্মে সামাজিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসর থেকে হেরেটিকদের যেমন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। আস্তিক বলতে, যাঁরা বৈদিক সাহিত্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্তৃত্বে, আত্মায় ও ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখেন। মনু থেকে মেধাতিথি, হরিভদ্র থেকে নাগার্জুন— দেখা যায় নাস্তিকের সংজ্ঞা নানাবিধ। নাস্তিক তাঁরাই, যাঁরা বৈদিক শ্রুতি ও স্মৃতিকে অস্বীকার করেন; বা পরলোক, জন্মান্তর, পাপ-পুণ্য, বা আত্মায় বিশ্বাস করেন না— ফলে বৈদিক পারলৌকিক ভাষ্যে তাঁদের আস্থা নেই। মহাভারত-এ সামগ্রিক ভাবে ঈশ্বর, বেদ ও পারলৌকিক কাজে অবিশ্বাসী যাঁরা, তাঁরাই নাস্তিক। কিন্তু তাই বলে সাতটি নাস্তিক দর্শনতত্ত্বকে একীভূত করে আস্তিক বনাম নাস্তিকের আলোচনাটি করেন না শামিম। এই অত্যন্ত দুরূহ নাস্তিক তত্ত্বগুলি সাধারণত বিশেষজ্ঞদের দর্শন বিষয়ক পুস্তক ছাড়া বাংলা ভাষায় দুর্লভ। শামিমকে এ কারণে ধন্যবাদ যে, তিনি শুধু অধ্যায় ভাগ করে মহাভারতের নাস্তিক-আস্তিক সংবাদ ও আস্তিক দ্বারা নাস্তিকের খণ্ডনকে দেখান না, তার আগে তিনি প্রতিটি নাস্তিক দর্শনের প্রাথমিক পরিচয়ের সূত্রগুলি পাঠককে ধরিয়ে দেন। মহাকাব্যের দার্শনিক পাঠকে তিনি দর্শন সন্দর্ভের নিজস্ব ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে আখ্যানের গতিষ্ণুতায় সাজান।

সেই আলোচনায় আরবি দর্শনের মতো ভারতীয় দর্শন অ্যারিস্টটলীয় চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত না হলেও শামিম দেখান, আন্বীক্ষিকী ‘সত্য’ ধারণার সঙ্গে অ্যারিস্টটলীয় চিন্তার কেমন আশ্চর্য সাযুজ্য রয়েছে। অন্য দিকে জানান, বুদ্ধ আর্যসত্য চতুষ্টয়ের ধারণা নির্ণয়ে কী ভাবে সমসাময়িক ভেষজ শাস্ত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, বা জৈন ধর্মের সংশয়বাদিতার সূত্রে আনেন কার্তেশিয়ান সংশয়, যা পাঠককে দর্শনের তুলনামূলক চিন্তার দিকে ঠেলে দেয়।

মহাভারতে ইতিহাস ও দর্শন একত্রিত হয়ে আছে এই কথা বলে শামিম মহাকাব্য ও তৎসহ বেদ ও পুরাণকে খানিকটা ইতিহাসের মাত্রা দিয়েছেন, আবার পড়েছেন প্রতীকী অর্থেও। নারদ, বৃহস্পতি, চার্বাক, কণাদ প্রমুখ শামিমের কাছে ধারণার নানা রূপ নন, এক-এক জন নির্দিষ্ট চরিত্র, যাঁদের তিনি নানা সন্দর্ভে খুঁজে পেয়ে তা থেকে একটা সামগ্রিকতা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। এই পাঠপদ্ধতিতে যখন বলা হয়, রাবণ বৈশেষিক মতের ভাষ্যকার, যে ভাষ্য খণ্ডন করেছেন শঙ্করাচার্য, তখন মহাকাব্যিক সময় ও ঐতিহাসিক সময় একীভূত হয়ে যায়। লেখক বলেছেন, শকুনিপুত্র উলুক, যিনি দুর্যোধনের দূত হয়েছিলেন, এবং বৈশেষিক দর্শন প্রণেতা কণাদ একই ব্যক্তি হতে পারেন। দুর্যোধনের বন্ধু চার্বাক— এই তথ্যকে তাঁর ব্যঞ্জনাধর্মিতা থেকে সরিয়ে লেখক লোকায়ত দর্শনের প্রবক্তা চার্বাক হিসেবে ধরেই আলোচনা করেন। ইনিই ঐতিহাসিক চার্বাক নাস্তিক আজীবিকপন্থার হোতা কি না, সেই প্রশ্ন না তুলে এ কথা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, লোকায়ত দর্শনচর্চা করতেন দুর্যোধন আর তাঁর নানা লোকায়তিক সংসর্গ ছিল। লোকায়তিক বন্ধু চার্বাক এসে দুর্যোধনের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবেন, এই কথা মৃত্যুর আগে তাঁর বিলাপে ছিল। প্রতিশোধ বলতে কি দুর্যোধন আস্তিকদের তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করার কথা বুঝিয়েছিলেন, যা করতে যুধিষ্ঠিরের অভিষেকে চার্বাক রাক্ষস নামে এক জন উপস্থিত হন? ব্রহ্মবাদীদের রোষানলে দগ্ধ হয়ে যান চার্বাক রাক্ষস। এ কি শুধু তর্কযুদ্ধে পরাজয়, না কি এর মধ্যে নাস্তিকের দণ্ডপ্রাপ্তির সঙ্কেত লুকিয়ে আছে? শেষ অবধি তো লেখক এটাও পাঠককে ভাবতে উস্কে দেন যে, জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ আসলে বৌদ্ধদের ধ্বংস করার একটি মহা-আড়ম্বর হতেই পারে। অর্থাৎ ক্রমে নাস্তিক দর্শনের যে প্রান্তিকীকরণ ঘটে ভারতীয় দর্শন চিন্তার মঞ্চে যে একটি বিশেষ পালাবদল আসছে, তা শুধু তর্কযুদ্ধের মধ্যে ভাবনার আগ্রাসনেই ঘটে না, শারীরিক নিগ্রহের মধ্যে দিয়েও হওয়ার ফলে, আস্তিক সমাজের দণ্ডনীতির কোনও রূপরেখা বা স্মৃতিশাস্ত্রের নিদান এখানে পড়া যেতে পারে কি না, সে বিষয়ে আগ্রহ থেকে যায়। এই বইটির একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রস্তাবনা হল, মহাভারতের নাস্তিক-আস্তিক দ্বন্দ্বকে সূর্যবংশীয় কৌরব (জড়বাদী) বনাম চন্দ্রবংশীয় পাণ্ডব (অধ্যাত্মবাদী) হিসেবে পড়া, এবং দেখানো যে নাস্তিক-আস্তিক মতগুলি সম্পূর্ণত বিরোধী নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক। জিজ্ঞাস্য, এই কাঠামোয় দ্রৌপদীর অবস্থান তা হলে কী হবে? যিনি বনমধ্যে থাকাকালীন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বার্তায় যা বলেন, তার মধ্যে চার্বাকতত্ত্বের আভাস পাওয়া যায়?

বিতণ্ডার ধাঁচে সাজানো মানে কি পরিপূরকতা? আস্তিক কি আত্মস্থ করে নিতে পারল শ্রামণিক নাস্তিককে? না হলে আস্তিকের টিকে যাওয়া তো সম্ভব নয়। তা হলে কতখানি নিল? ঠিক কী কী নিল? প্রব্রজ্যাকে আত্মস্থ করতেই কি ব্রাহ্মণ্য চতুরাশ্রমের অন্তিম পর্যায়টি সন্ন্যাস? প্রবৃত্তির মধ্যে নিবৃত্তি জায়গা পাওয়ায়, সমাজে কী ভাবে নবপর্যায়ে আস্তিক মতে গড়ে উঠল? অন্য দিকে, দুই মহাকাব্যের দুই প্রতিনায়ক, দুর্যোধন ও রাবণ, উভয়ে শিবের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা জানিয়েছেন, যিনি বৈশেষিক দর্শনের মূল। এ ক্ষেত্রে শিবের বিপরীত দেবতাটি কে? মহাকাব্যে তাঁর আস্তিক দর্শনের রূপটিই বা কী?

লেখক বলেন, যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে পূর্বপক্ষ হিসেবে হাজির করেছেন আস্তিক, কিন্তু সে উল্লেখ তো শেষ অবধি খারিজ করার জন্য। এই নাস্তিক মতগুলি ব্রাহ্মণ্য সমাজের অনুশাসনের বর্ণব্যবস্থা না মানায়, এগুলি কী ভাবে ক্রমে অ-দ্বিজ মানুষদের বিকল্প সমাজের ধারণা দিয়েছিল, জ্ঞানচর্চার পরিসর হয়ে উঠেছিল, তা-ও আজ আলোচিত। গীতায় নিষ্কাম কর্ম ও বর্ণধর্ম তো সেই বর্ণব্যবস্থা প্রচলনের একটি সন্দর্ভও বটে। শামিমের উদ্দেশ্য সামাজিক ইতিহাস রচনা নয়। যদিও, তাঁর করা দার্শনিক প্রস্থানগুলির বিশ্লেষণে ও আস্তিকদের হাতে নাস্তিক মত খণ্ডনের নিজস্ব প্রতিপাদ্যে সমাজ বদলের ইশারাই ধরা পড়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE