Advertisement
০৬ মে ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

চেয়ারের প্রতিমাকল্পে ক্ষমতার বিপন্নতা

সম্প্রতি সিমা-তে অনুষ্ঠিত মনসুর আলি-র প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষউত্তর-আধুনিকতার প্রধান একটি লক্ষণ, তা সব সময়ই ‘ক্ষমতা’-কে প্রশ্ন করে। মানুষের সভ্যতা নিয়ন্ত্রিত হয় ‘ক্ষমতা’ দ্বারা। এই ক্ষমতার প্রক্রিয়া ও প্রকৃতি দ্বান্দ্বিক। এক দিকে তা উদ্ভাবন ও বিকাশের উৎস। আর এক দিকে সংঘর্ষ, হিংসা ও সন্ত্রাসেরও উৎস।

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

উত্তর-আধুনিকতার প্রধান একটি লক্ষণ, তা সব সময়ই ‘ক্ষমতা’-কে প্রশ্ন করে। মানুষের সভ্যতা নিয়ন্ত্রিত হয় ‘ক্ষমতা’ দ্বারা। এই ক্ষমতার প্রক্রিয়া ও প্রকৃতি দ্বান্দ্বিক। এক দিকে তা উদ্ভাবন ও বিকাশের উৎস। আর এক দিকে সংঘর্ষ, হিংসা ও সন্ত্রাসেরও উৎস। উত্তর-আধুনিক প্রকল্পের একটি উদ্দেশ্য ছিল ‘ক্ষমতা’-র সামনে তার ধ্বংসাত্মক স্বরূপ তুলে ধরা। তার প্রকৃতিকে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করা।

সিমা গ্যালারিতে এখন চলছে বরোদা-ভিত্তিক শিল্পী মনসুর আলি মাকরানি-র দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী। এই শিল্পী ২০১৫-তে প্রথম সিমা অ্যাওয়ার্ডস প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ প্রদর্শের পুরস্কার পেয়েছিলেন। শিল্প-শিক্ষা বরোদায়। সেখান থেকেই তিনি ২০০২ ও ২০০৪ সালে ভাস্কর্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছিলেন। প্রায় এক দশক ধরে তাঁর কাজের কেন্দ্রীয় বিষয় ‘চেয়ার’। আলোচ্য প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘হুজ চেয়ার ইজ ইট, এনিওয়ে?’ যে ভাস্কর্য মূলক প্রদর্শের জন্য তিনি সিমা-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন সেই রচনারও শিরোনাম ছিল ‘অ্যানাটমি অব আ চেয়ার’। ‘চেয়ার’ তাঁর কাছে ক্ষমতা-র একটি প্রতীক, উত্তর-আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলে ‘সিগনিফায়ার’। ‘সিগনিফায়ার’ হিসেবে চেয়ারকে বিখ্যাত করেছেন প্রখ্যাত আমেরিকান উত্তর-আধুনিক শিল্পী জোসেফকোসুথ (জ.১৯৪৫)। ১৯৬৫-তে রচিত তাঁর ভাস্কর্য-ইনস্টলেশনধর্মী একটি রচনার শিরোনাম ছিল ‘ওয়ান অ্যান্ড থ্রি চেয়ার্স’। মনসুর আলি এই প্রদর্শনীতে কোসুথ-এর সেই রচনাটিকে পুনর্নিমাণ করেছেন। সেই নির্মাণের সঙ্গে তাঁর নিজস্ব সংযোজন একটি ভিডিও। যেখানে একটি চেয়ার ক্ষুদ্রতম আয়তন থেকে বিস্ফারিত হতে হতে সমগ্র প্রেক্ষাপটকে ছাড়িয়ে যেতে চাইছে। ক্ষমতা-র বিস্ফারণকে এভাবেই শিল্পী চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।

কোসুথ-এর চেয়ারের সংজ্ঞাকে মনসুর উদ্ধৃত করেছেন। সেই সংজ্ঞার শেষ বাক্যটি হল ‘however, there do exist humble chairs as well’. এই নম্র চেয়ারের দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে পড়তে পারে ১৮৮৮-তে আঁকা ভ্যান গঘের চেয়ারের কথা। আর্ল – পর্বে ওই একই বছর গঁগাও এঁকেছিলেন ‘চেয়ার’। ভ্যান গঘের চেয়ারে ছিল করুণার আবহ। গঁগা-র চেয়ারে কিছু পরিমাণে ছিল ক্ষমতার আবহ। পিকাসো-র ১৯১১-১২ সালের একটি সুপরিচিত রচনার শিরোনাম ‘স্টিল লাইফ উইথ চেয়ার কেনিং’। তাতে তিনি চেয়ার আঁকেননি। চেয়ারের বেতের আবরণটি ব্যবহার করে ক্ষমতারই একটি অনুষঙ্গ আনতে চেয়েছিলেন হয়তো। আর একজন আমেরিকান শিল্পী ১৯৩৬-এ, দুটি চেয়ার নিয়ে ভাস্কর্য-ইনস্টলেশন করেছিলেন, যার একটির উপর অজস্র তীক্ষ্ণ পিন ফোটানো ছিল। ২০০৩-এ ইস্তাম্বুল বিয়েনালে ডোরিস সালসেডো নামে এক শিল্পীর ‘১৫৫০ চেয়ারস্’ শিরোনামের ইনস্টলেশনটিতে স্তূপীকৃত করে রাখা অজস্র চেয়ার।

মনসুর আলি এই উত্তরাধিকারকে নতুন অর্থে অর্থান্বিত করেছেন। প্রদর্শনীতে রয়েছে তাঁর চিত্র, ভাস্কর্য, ইনস্টলেশন ও ভিডিও নিয়ে মোট ১২ টি রচনা। ‘হুজ চেয়ার ইজ ইট’, এনিওয়ে? – ২’ শীর্ষক আর্চিভাল প্রিন্টের রচনায় তিনি যে চেয়ারটি উপস্থাপিত করেছেন, সুদৃশ্য সেই চেয়ারটির এক দিকে একটি হাতল নেই। এই অনুপস্থিতি হয়তো ক্ষমতার প্রতিবন্ধী পরিস্থিতির ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু ক্ষমতা-র এই বিপন্নতাকে শিল্পী শুধু চেয়ারের প্রতিমাকল্পেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। দেশের যে বাস্তব পরিস্থিতি, স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭০ বছর পরেও পরিব্যাপ্ত সামাজিক সংকটকেই তিনি নানা ভাবে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন। সেই বিপন্নতার বিষাদ সমগ্র প্রদর্শনীতে নিঃশব্দে ধ্বনিত হচ্ছে। ‘অ্যাজ দে স্লাইড অ্যান্ড গ্লাইড’ শীর্ষক ভিডিও-টি এর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। চলমান এক শহরকে তিনি চলচ্চিত্রায়িত করেছেন। এর সংকট ও সমস্যাকে উন্মীলিত করেছেন। পাশে ধ্রুবকের মতো অবস্থান করেছে একটি চেয়ার। ‘হোয়াইট চেয়ার অন আ হোয়াইট বেড’ শিরোনামের ইনস্টলেশনটিতে একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠের ভিতর অতি ক্ষুদ্রাকার শুভ্র বিছানার উপর রয়েছে সাদা একটি ছোট চেয়ার। তমসার সঙ্গে ক্ষমতার এই নিভৃত সংলাপ রহস্যময়তার আবহ সৃষ্টি করে। ‘এজ ওল্ড কনভার্সেশন’ শীর্ষক ইনস্টলেশনটিতে ‘রেডিমেড’ পাথর ব্যবহার করে ভাস্কর্যের এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছেন, যা তাঁর স্বকীয়তার স্বাক্ষর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mansoor ali CIMA Exhibition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE