Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

এখানে কোনও গ্ল্যামার নেই

কেউ বিপদে পড়লে তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর দৌড় ওর জন্য নয়। সুনীতা হাজরাকে এভারেস্টের ‘ব্যালকনি’তে মুমূর্ষু অবস্থায় বাঁচিয়েছেন যিনি, তাঁর স্ত্রীর-ই তো এ কথা বলা সাজে! এ কথা সেই লেসলি জনস বিনসের স্ত্রী লিন্ডসে এম্প্রিংহ্যাম-এর।

ধৌলাগিরি ও মাকালু/ রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা। দেবাশিস বিশ্বাস। আনন্দ, ৪০০.০০।

ধৌলাগিরি ও মাকালু/ রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা। দেবাশিস বিশ্বাস। আনন্দ, ৪০০.০০।

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

কেউ বিপদে পড়লে তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর দৌড় ওর জন্য নয়।

সুনীতা হাজরাকে এভারেস্টের ‘ব্যালকনি’তে মুমূর্ষু অবস্থায় বাঁচিয়েছেন যিনি, তাঁর স্ত্রীর-ই তো এ কথা বলা সাজে! এ কথা সেই লেসলি জনস বিনসের স্ত্রী লিন্ডসে এম্প্রিংহ্যাম-এর। আসলে, এই কথা যে কোনও সাচ্চা অভিযাত্রীর মর্মকথা। এভারেস্টের চূড়া আর মাত্র মিটার চারশো। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে এসে সেই এভারেস্ট জয়ের প্রাক মুহূর্তে যাবতীয় ইচ্ছা দমন করে আর এক বিপন্ন অভিযাত্রীর প্রাণ বাঁচানোর এই মরিয়া প্রয়াসও আসলে পর্বতেরই শিক্ষা। পাহাড় বড় ভয়ঙ্কর সুন্দর। পাহাড় বড়ই মায়াবী।

এতই মায়াবী যে বারে বারে মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে পাহাড় পাগল কিছু মানুষ ছুটে যান। কেন? কী দেখতে, কীসের টানে এই অনন্ত পরিক্রমা? এর উত্তরও কি এককথায় দেওয়া যায়? যে বিমানে পর্বতারোহী রাজীব ভট্টাচার্যের কফিনবন্দি দেহ ফিরল কলকাতায়, সেই একই বিমানে ফিরলেন সুনীতা হাজরাও। শোকের মাত্রার প্রমাণ কি শুধু চোখের জলেই মেলে? সঙ্গী পর্বতারোহীদের সেই হিমালয়ের কোলে চিরনিদ্রায় ফেলে আসার পরেও এভারেস্ট জয়ের আনন্দ সুনীতাকে স্পর্শ করতে পারেনি। পারার কথাও নয়। এ বারের মতো আর সমতলে নামানো যাবে না গৌতম ঘোষ ও পরেশ নাথের দেহ। শেষ বারের মতো বাঁকুড়ার ভিটেয় পৌঁছে গিয়েছেন আর এক অভিযাত্রী সুভাষ পাল।

‘সাগরমাতা’ কি তা হলে এতটাই ক্রুদ্ধ হলেন অভিযাত্রীদের উপর?

মৃত্যু এর আগেও বহু বার দেখেছে এভারেস্ট। বহু বার বহু পর্বতারোহী ও শেরপা শেষ আশ্রয় নিয়েছেন ওই এভারেস্টের কোলেই। কিন্তু এ বারের মৃত্যুমিছিলের মুখগুলো যেন বড় কাছাকাছির মুখ! যেন ডাকলেই সাড়া দেবে পাশের বাড়ির ওই মুখগুলো।

আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রখ্যাত পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাসের ধৌলাগিরি ও মাকালু/রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা বইটি প্রায় এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলে আরও এক বার অনুভব হল, তুষারশুভ্র গিরিশৃঙ্গ কেন এত ভয়ঙ্কর আকর্ষণীয়! কেন এক জন পর্বতারোহী তাঁর মনুষ্যত্বে, তাঁর চেতনে, তাঁর হৃদয় বৃহৎ থেকে বৃহত্তর করতে করতে আমার-আপনার মতো আরও পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে উচ্চতায় অনেক বড় হয়ে যান! ধৌলাগিরি অভিযানের কথকতা লিপিবদ্ধ করার আগে ‘স্মরণ’ প্রসঙ্গে দেবাশিস লিখছেন, ‘আমার অতিপ্রিয়, ভ্রাতৃপ্রতিম দাওয়া ওয়াঙ্গচুক শেরপাকে, যে ধৌলাগিরি অভিযানে মৃত্যুমুখ থেকে বসন্ত সিংহ রায়কে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিল অথচ পরের বছর ইয়ালুংকাং অভিযানে ছন্দার সঙ্গে হারিয়ে গেল চির তুষারের রাজত্বে।’

বসন্ত সিংহ রায় ও দেবাশিস বিশ্বাস। অনেকে তাঁদের বলেন, পর্বতারোহণে লি-হেশ জুটি। টেনিসের বিখ্যাত জুটি লিয়েন্ডার পেজ ও মহেশ ভূপতির কথা ভেবে। তবে, তাঁদের এই জুটি অটুট রয়েছে ১৯৯৭ সাল থেকে। ডায়েরি লেখার ধাঁচে প্রথমে ধৌলাগিরি অভিযানের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন দেবাশিস। আর সেই কাহিনির ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে ভূপৃষ্ঠ থেকে আট হাজার মিটার উপরের এক্কেবারে অজানা এক পৃথিবীর কথা! এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা— পর পর তিন বছর এই তিনটি আট হাজারি শৃঙ্গ জয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে ধৌলাগিরি অভিযানে বেরিয়েছিলেন বসন্ত, দেবাশিস ছাড়াও হাওড়ার আর এক পর্বতারোহী মলয় মুখোপাধ্যায়। পৃথিবীর সপ্তম উচ্চতম শৃঙ্গ ধৌলাগিরির উচ্চতা ৮১৬৭ মিটার, অর্থাৎ ২৬৭৯৫ ফুট।

এখানেই দুর্ঘটনায় পড়েন বসন্ত ও দেবাশিস। মৃত্যুমুখে চলে যান বসন্ত। বরফের রাজ্যে প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া দেবাশিস কোনও ক্রমে সেখান থেকে উদ্ধার পেলেও কী ভাবে বসন্ত সিংহ রায়কে উদ্ধার করে হেলিকপ্টারে নীচে পাঠানো গিয়েছিল, দেবাশিসের কলমে সেই বর্ণনা পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দেয়! গুরুতর অসুস্থ এবং খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়া বসন্তকে শেরপারা দড়ি দিয়ে বেঁধে বরফের উপর দিয়ে ঘষতে ঘষতে যে ভাবে নীচের ক্যাম্পে নামিয়েছিলেন, সে কাহিনি জানলে শেরপাদের সম্পর্কে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়! ওই ধৌলাগিরি অভিযানেই দেবাশিসদের পথসঙ্গী এক জাপানি মহিলা, স্পেনের এক অভিযাত্রী এবং আর এক শেরপা আর ফিরতে পারেননি। এভারেস্টের পথে একেবারে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পরে কোনও কোনও শেরপার ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্নই উঠুক না কেন, হিমালয় শোনাবে পেম্বা বা দাওয়ার মতো শেরপাদের মানবিক বোধের অসংখ্য কাহিনি। শোনাবে, স্রেফ টাকা রোজগারের জন্যই কেউ এ ভাবে নিজের জীবন বিপন্ন করে না।

পরের বছর মাকালু অভিযানে স্বাভাবিক ভাবেই বসন্ত আর সঙ্গী হতে পারেননি দেবাশিসের। তুষার ক্ষতের (ফ্রস্ট বাইট) জন্য বসন্ত সিংহ রায়ের পায়ের বেশ কয়েকটি আঙুল বাদ দিতে হয়েছিল, হাঁটুর কাছ থেকে বেশ খানিকটা মাংস কেটে ফেলতে হয়, প্রবল ঠান্ডায় বুকে আলসার হয়ে যায়। বিশ্বের পঞ্চম উচ্চতম শৃঙ্গ মাকালুর রোমহর্ষক সেই অভিযানেও চরম বিপদে পড়েন দেবাশিস।

দেবাশিসের এই বইটি পড়তে পড়তে মনে পড়ে পর্বতাভিযানের আর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ইনটু থিন এয়ার-এর কথা। সাংবাদিক জন ক্র্যাকার-এর সঙ্গী পাঁচ পর্বতারোহীর মধ্যে চার জনই সেই ‘সফল’ এভারেস্ট শৃঙ্গজয়ের পরে ফেরার সময় ভয়াবহ তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারান। তাঁদের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত পর্বতারোহী রব হল-ও ছিলেন। সেই অভিযানেই চারটি অভিযাত্রী দলের মোট ৯ জন মারা যান। ১৯৯৬-এর মার্চের সেই অভিযানের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছিলেন জন।

চির-রহস্যে ঘেরা হিমালয়! পর্বতাভিযান এমনই এক অভিযান, যার কোনও গ্যালারি নেই! গ্ল্যামার? সে তো ক্রিকেটে! নেট প্র্যাক্টিসও মিডিয়ায় কত জায়গা পায়! আর রাজীব-গৌতম-সুভাষ-পরেশরা শেষমেশ কয়েক দিনের প্রচার পান বটে, তবে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে!

দেবাশিস বিশ্বাস সেই পর্বতারোহীদের উচ্চতাকেই তাঁর এই গ্রন্থে আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে দিলেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

expedition Everest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE