Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

‘আমার সম্ভ্রান্ত হবার দরকার নেই’

বুদ্ধদেব বসু নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনের প্রেক্ষিতকে যতখানি বিবেচনা করেছেন, জাতির সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে কবি নজরুলের সংস্থানকে ততখানি বিচার করেন নি’— এমন মন্তব্য করেছেন শেখ মকবুল ইসলাম, তাঁর নজরুল নানা মাত্রা (উদার আকাশ, ১৩০.০০) নামের একাধিক প্রবন্ধের এক সংকলনগ্রন্থে। নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের ওপর ‘স্থির তথ্যচিত্র’ (স্টিল ডকুমেন্টারি) করতে গিয়ে লেখক নজরুল সাহিত্যের নানা বিষয়ে উৎসাহিত হয়েছিলেন।

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০০:১৩
Share: Save:

বুদ্ধদেব বসু নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনের প্রেক্ষিতকে যতখানি বিবেচনা করেছেন, জাতির সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে কবি নজরুলের সংস্থানকে ততখানি বিচার করেন নি’— এমন মন্তব্য করেছেন শেখ মকবুল ইসলাম, তাঁর নজরুল নানা মাত্রা (উদার আকাশ, ১৩০.০০) নামের একাধিক প্রবন্ধের এক সংকলনগ্রন্থে। নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের ওপর ‘স্থির তথ্যচিত্র’ (স্টিল ডকুমেন্টারি) করতে গিয়ে লেখক নজরুল সাহিত্যের নানা বিষয়ে উৎসাহিত হয়েছিলেন। নানা কারণে অসমাপ্ত সেই গবেষণাজাত কিছু তথ্য, দিনপঞ্জি, নজরুল স্মৃতিবাহী একাধিক বাড়িঘরের ছবি ও নজরুলের ইসলামি গান, নজরুল: মুসলিম নারী: সমস্যার নানা মাত্রা ইত্যাদি একাধিক প্রবন্ধে লেখক ব্যক্তি নজরুল, সমাজ ও রাজনীতিসচেতন সাহিত্যিক নজরুলকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ‘...আমার সম্ভ্রান্ত হবার দরকার নেই, আমার বিভ্রান্ত করবার কথা’— নিজের সম্বন্ধে নজরুলের ছিল এমন ভাবনা। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এক ব্যতিক্রমী সত্তার আলোচনায় অনেক সময় প্রাজ্ঞজনও বিভ্রান্ত হন। আলোচ্য বইটিতে শেখ মকবুল ইসলাম বলেছেন, ‘...নজরুল বাঙালি সংস্কৃতির স্মরণীয় মুসলিম ব্যক্তিত্ব।... ব্যক্তিজীবনে তিনিও হিন্দুমতে সাধনা করে সাংস্কৃতিক সমন্বয় চেতনার উজ্জ্বল প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।’ পাশাপাশি রাখা যাক বুদ্ধদেব বসুর কথা, যার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন শেখ মকবুল ইসলাম— ‘মুসলমান তিনি, ভিন্ন একটা ঐতিহ্যের মধ্যে জন্মেছিলেন, আবার সেই সঙ্গে হিন্দু মানসও আপন করে নিয়েছিলেন— চেষ্টার দ্বারা নয়, স্বভাবতই।’ এ দুইয়ে ফারাক কোথায়? মকবুল আরও লিখেছেন (পৃ ১৩৪), ‘অন্নদাশংকর রায় ওড়িশার নজরুল প্রভাবিত কবিদের মধ্যে অন্যতম’— অন্নদাশংকর দীর্ঘদিন ওড়িশায় বাস করেছিলেন, ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর দক্ষতা ছিল, তবু তিনি কি ‘ওড়িশার’?

নজরুল প্রসঙ্গে কবি গোলাম মোস্তাফা লিখেছিলেন, ‘ভায়া লাফ দেয় তিন হাত/ হেসে গান গায় দিনরাত।/ প্রাণে ফূর্তির ঢেউ বয়/ ধরায় পর তার কেউ নয়’ (কল্লোলযুগ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)। এ হেন নজরুলকে অনুবাদে ধরা কিছুটা দুষ্কর। প্রধানত তিনি ‘স্বভাবকবি’, তাঁর কবিতার বিশিষ্টতা ছন্দের চপলতায় ও বাগ্ভঙ্গির ওজস্বিতায়’ আর ‘তৎসম ও তদ্ভব শব্দের সঙ্গে আরবি-ফারসি-হিন্দি শব্দের’ অনায়াস প্রয়োগে। এ সব সমস্যা সত্ত্বেও কবি গিয়াসউদ্দিন দালাল সিলেক্টেড নজরুল বইয়ে (খণ্ড ১, বুকস ওয়ে, ৬৯৫.০০) ৩৭টি কবিতা, ৬২টি গান এবং ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি অনুবাদ করেছেন। কবিতা ও গানের ক্ষেত্রে এক দিকে মূল বাংলায় কবিতা/ গানটি ছাপা হয়েছে রোমান হরফে, পাশের পাতায় অনূদিত রূপটি। ‘আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি/ ছল করে দেখা অনুখন’-এর স্নিগ্ধতা যদি ‘I Am the fleeting glance of a hidden lover/ And their meeting on pretext always’-এ খুঁজে না-ও পাওয়া যায়, তবুও কিন্তু ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই/ নহে কিছু মহীয়ান’-এর পাশেই রাখা যায় ‘Let me recite the song of equality/ Nothing is greater than man, nothing so exalted.’ ‘নয়নভরা জল গো তোমার আঁচলভরা ফুল’ অনুবাদে হয়েছে ‘Eyes full of water you have handful of flowers’। নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’-র প্রথম অনুবাদ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আদ্যন্ত বাঙালি নজরুলকে ইংরেজি অনুবাদের মধ্যে দিয়ে ইংরেজিভাষী পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে এই বই সহায়ক হবে। বইটির কাগজ, বাঁধাই, ছাপা, বিন্যাস সুন্দর, প্রচ্ছদ শোভন।

‘নজরুল বিষের বাঁশি বাজাচ্ছে আর সে-সুর সে-কথা সবাইকার রক্তে বিদ্রোহের দাহ সঞ্চার করছে’— বলেছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। সে বিদ্রোহী সুর ছুঁয়ে গিয়েছিল হিন্দি সাহিত্যকেও। বিশিষ্ট হিন্দি কবি রামধারী সিংহ ‘দিনকর’ আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘...বংগলা সীখকর তভী মৈঁ নে রবীন্দ্র ঔর নজরুল সে পরিচয় বঢ়া লিয়া থা।’ পরে তিনি হয়ে ওঠেন নজরুলের উত্তরসূরি। এই দুই কবিকে নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কল্যাণী মণ্ডল, তাঁর নজরুল ও দিনকর: ধ্যানে অনুধ্যানে (আখ্যান, ২০০.০০) বইতে। নজরুলের মতোই দিনকর ছিলেন সুপুরুষ, সুগায়ক, দরিদ্র পরিবারের সন্তান, দেশবাসীর প্রতি তাঁর ছিল সুগভীর ভালবাসা। গান ভালবাসা, গান লেখা, দেশপ্রেমে তিনি ছিলেন নজরুলের সমমনস্ক। সরকারি চাকরি করলেও দিনকর রাষ্ট্রীয় জাগরণ ও বিদ্রোহের কবিতা লিখেছেন। তথ্যসমৃদ্ধ, সুলিখিত প্রবন্ধগ্রন্থে ‘দিনকর’ সাহিত্যে নজরুলের প্রভাব ব্যাখ্যা করে বাঙালি পাঠকের কাছে স্বল্পপরিচিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই কবিকে তুলে ধরার জন্য কল্যাণী মণ্ডল বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার।

কাজী নজরুল ইসলাম রচিত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাব্যিক জীবনী মরু-ভাস্কর পশ্চিমবঙ্গে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। তারপর বিবিধ সংগ্রহে এটি অন্তর্ভুক্ত হলেও আলাদা বই হিসেবে বেরোয়নি। বর্ধমানের কবিতীর্থ চুরুলিয়ার নজরুল আকাদেমি-র সাধারণ সম্পাদক, কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী মজাহার হোসেন-এর অনুমতি পাওয়ার পর নজরুল-গবেষক মিজানুর রহমান গাজি-র সম্পাদনায় মরু-ভাস্কর পুনরায় প্রকাশ করল চারুপাঠ (১০০.০০)। ভূমিকা-য় সম্পাদক জানিয়েছেন “ ‘মরু-ভাস্কর’ সম্পর্কে চালু প্রবাদ আছে, এটি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী। এই প্রবাদ সত্য নয়। কবি ‘মরু-ভাস্কর’-এ মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্ম পূর্ববর্তী অস্থির আরব থেকে তাঁর নবীত্ব লাভ পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন।”

কবিকৃত কুরআন শরীফ-এরও কাব্যনুবাদ কাব্য আমপারা ১৯৩৩-এ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর আর বেরোয়নি, বিবিধ সংগ্রহে সংকলিত হয়েছে। এটিও কবির ভ্রাতুষ্পুত্রের অনুমতি পাওয়ার পর প্রকাশ করল চারুপাঠ (১০০.০০)। এটি সম্পাদনা করেছেন আবদুর রউফ, ‘সম্পাদকের কথা’য় তিনি চিনিয়ে দিয়েছেন নজরুলের প্রতিভার অন্য একটি দিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kazi nazrul islam buddhadeb basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE