Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

ক্যানভাসে চিত্রদর্শন মেঝেতে তাঁর জীবনদর্শন

মায়া আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল যোগেন চৌধুরীর প্রদর্শনী ‘দ্য আদার সেল্ফ’। লিখছেন মৃণাল ঘোষআমার ছবি তোলা বিষয়টি একেবারেই আনপ্রফেশনাল— যেমন সবাই ছবি তোলে— তেমন। যোগেন চৌধুরী এ কথা বলেছেন তাঁর আলোকচিত্র সম্বন্ধে। মায়া আর্ট স্পেস গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর তোলা ৩৫ টি আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী। শিরোনাম: ‘দ্য আদার সেল্ফ’। এই প্রদর্শনীরই ভূমিকা স্বরূপ এক লেখায় শিল্পীর এই মন্তব্য। তাঁর সৃজনের এই যে অন্য একটি দিক, যাকে বলা হচ্ছে ‘আদার সেল্ফ’, তাকে এত দিন তিনি সাধারণ লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন।

শিল্পী: যোগেন চৌধুরী

শিল্পী: যোগেন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪ ০০:৩২
Share: Save:

আমার ছবি তোলা বিষয়টি একেবারেই আনপ্রফেশনাল— যেমন সবাই ছবি তোলে— তেমন। যোগেন চৌধুরী এ কথা বলেছেন তাঁর আলোকচিত্র সম্বন্ধে। মায়া আর্ট স্পেস গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর তোলা ৩৫ টি আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী। শিরোনাম: ‘দ্য আদার সেল্ফ’। এই প্রদর্শনীরই ভূমিকা স্বরূপ এক লেখায় শিল্পীর এই মন্তব্য। তাঁর সৃজনের এই যে অন্য একটি দিক, যাকে বলা হচ্ছে ‘আদার সেল্ফ’, তাকে এত দিন তিনি সাধারণ লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল এর ভিতর সে রকম কোনও পেশাদারিত্ব নেই। যে পেশাদারী দক্ষতায় তিনি ছবি আঁকেন, তাঁর ছবি তোলায় সে রকম অনুশীলন-সঞ্জাত দক্ষতা নেই। অর্থাৎ এটা তাঁর নিতান্তই একটি শখ।

অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘরোয়া’-র স্মৃতিচারণার একেবারে শুরুতে বলেছিলেন: ‘শিল্প হচ্ছে শখ। যার সেই শখ ভিতর থেকে এল সেই পারে শিল্প সৃষ্টি করতে, ছবি আঁকতে, বাজনা বাজাতে, নাচতে, গাইতে, নাটক লিখতে— যা’ই বলো’। এই যুক্তিতে বলা যেতেই পারে যোগেন যে ছবি আঁকেন, সেটাও তাঁর একটা শখ। তাহলে ছবি আঁকা ও ছবি তোলা— এই দুই শখের মধ্যে পার্থক্য কী? ছবি আঁকাতে শিল্পী যে পরিমাণ ধ্যান ও অনুশীলন দিতে পেরেছিলেন, ছবি তোলাতে তা দিতে পারেননি। এই কুণ্ঠিত ইঙ্গিতটুকুই তিনি রাখতে চেয়েছেন আলোকচিত্রের প্রদর্শনীর ভূমিকায়। এতে অসত্য নেই।

এ কথা ঠিকই পেশাদারিত্ব শিল্পসৃষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। পাশাপাশি এ রকম দৃষ্টান্তও বিরল নয় যেখানে শিল্পী তথাকথিত পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে কেবলমাত্র শৌখিনতায় ভর করে এমন সৃষ্টি করেছেন, যা সৃজনের ক্ষেত্রে গভীর অভিঘাত আনতে পেরেছে। পিকাসোর নাটক লেখা, রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি কাটাকুটি করে ছবি গড়ে তোলা, অবনীন্দ্রনাথের ‘সুদূর যাত্রা’-র মতো যাত্রাপালা রচনা, হুসেনের ‘থ্রু দ্য আইজ অব আ পেইন্টার’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ এই সফলতারই কয়েকটি উদাহরণ। যোগেন চৌধুরীর আলোকচিত্র এরকম কোনও সার্থকতার শিখরে পৌঁছল কি না এই বিতর্কে না গিয়েও এ কথা বলা যায়, যে আলোকচিত্রের মধ্য দিয়ে তাঁর মননের একটি দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ আভাসিত হয়েছে, যা তাঁর সামগ্রিক শিল্পীসত্তায় আলো ফেলে।

যোগেন চৌধুরী তাঁর প্রথম ছবিটি তুলেছিলেন ১৯৬৬ সালের ১৪ জানুয়ারি প্যারিসে একটি ফোটোগ্রাফির দোকানে, সেখান থেকে তিনি জীবনের প্রথম ক্যামেরাটি কিনেছিলেন। রোল ফিল্মে তোলা সেই আলোকচিত্রে চার জন মানুষের অবয়বকে তিনি ক্যামেরাবদ্ধ করেছিলেন। তার পর থেকে নানা উপলক্ষে, নানা প্রয়োজনে তিনি ছবি তুলে গেছেন। যে ৩৫টি ছবি এই প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে, তাতে অবয়ব বা মুখাবয়ব আছে, নৃত্যের ছবি, বিভিন্ন শিল্পীর ছবি, অন্যান্য রচনামূলক ছবিও আছে। ধীরে ধীরে তাঁর প্রকরণ পরিশীলিত হয়েছে। বিষয়ের গভীরে তিনি প্রবেশ করেছেন, যা থেকে ব্যক্তিগত জীবনবোধের আভাস উঠে আসে।

সে রকম দু’টি ছবি। একটি ছবির শিরোনাম ‘মাই স্টুডিয়ো’। তাঁর একটি বিখ্যাত সুপরিচিত ড্রয়িংধর্মী ছবি আঁকা শেষ হয়ে গিয়েছে। যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে বরফের স্ল্যাবের উপর উপুড় হয়ে শায়িত নগ্ন একটি মৃতদেহ, সন্ত্রাসের শিকার। সেই ক্যানভাসটি দেয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে। একটু আগে শিল্পী ছবিটি আঁকছিলেন। মেঝেতে পাটি পাতা। তার উপর রঙের টিউব, তুলি, প্যালেট, কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি রয়েছে। আর রয়েছে শিল্পীর চশমাটি। শিল্পী উঠে গিয়ে ক্যামেরায় এই দৃশ্যের ছবি তুলেছেন। ক্যানভাসে তাঁর চিত্র-দর্শন, মেঝেতে তাঁর জীবনদর্শন। প্রতিবাদ ও ভালবাসার দুই আলেখ্য মিলেছে এই ছবিটিতে। অপেশাদারিত্বকেই শিল্পী প্রসারিত করেছেন তাঁর জীবনদর্শনে।

অপেশাদারিত্বও যে অনেক সময় শিল্পীর মননকে স্বতন্ত্র আলোয় উদ্ভাসিত করে, এর দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা দেখে নিতে পারি আর একটি ছবি। যার শিরোনাম ‘হাউজ ওয়ার্মিং ডে— শান্তিনিকেতন’। শান্তিনিকেতনে শিল্পীর বাড়িতে একটি পুজো-অনুষ্ঠানের দৃশ্য এটি। এক তলায় মেঝের উপর সাজানো নানা পূজা উপচার। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। যজ্ঞের অগ্নিশিখা জ্বলছে। পবিত্র এক ধর্মীয় পরিবেশ। পরম্পরার আলোয় আলোকিত শিল্পীর মনটিকে পাওয়া গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mrinal ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE