Advertisement
E-Paper

চেনা জীবনকেই তাঁরা বিষয় করে তুলেছেন

নলিনী বেরা এবং সৈকত রক্ষিত চার দশকেরও বেশি গল্প-উপন্যাস লিখছেন। সত্তরের দশক থেকে বাংলা কথাসাহিত্যের যে নবযাত্রা তার অন্যতম যাত্রী নলিনী ও সৈকত। সত্তর দশকের বিশেষ একটি রাজনৈতিক স্লোগান ছিল গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলা। তা রাজনীতিতে কতখানি সফল হয়েছিল কে জানে, কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্যে গ্রামজীবন বিস্তৃত জায়গা দখল করে।

রামকুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

নলিনী বেরা এবং সৈকত রক্ষিত চার দশকেরও বেশি গল্প-উপন্যাস লিখছেন। সত্তরের দশক থেকে বাংলা কথাসাহিত্যের যে নবযাত্রা তার অন্যতম যাত্রী নলিনী ও সৈকত। সত্তর দশকের বিশেষ একটি রাজনৈতিক স্লোগান ছিল গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলা। তা রাজনীতিতে কতখানি সফল হয়েছিল কে জানে, কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্যে গ্রামজীবন বিস্তৃত জায়গা দখল করে। যেমন নলিনীর লেখায় আসে পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা সীমানাবর্তী সুবর্ণরেখা নদীতীরের জনপদ আর সৈকতের লেখায় পুরুলিয়ার বরাবাজার বান্দোয়ান মানবাজার ইত্যাদি অঞ্চল। নানান পরিবর্তনের পরেও নলিনী-সৈকতের লেখা এখনও স্বজন-স্বভূমিচ্যুত হয়নি, এও কম কথা নয়।

নলিনীর ঝিঙাফুল কাঁকুড়ফুল চারটি ছোট উপন্যাসের সংকলন। প্রতিটি তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার শব্দের মধ্যে লেখা। প্রথম উপন্যাসটির নাম ‘নষ্টকীর্তন’। কার্তিক-অঘ্রানে যখন রাঙাশাল জামাইনাড়ু কালোজিরে জনকলস ধান উঠে মাঠ-জমিন ন্যাড়া, মানুষ তখন আয়েশ করে। তেমনই একদিন গ্রামের কিছু আমুদে মাতব্বর বারিপদা-ফেরত গিরিবালার দলটিকে আটকে দেয় দু’ছাঁদ গান শুনতে। সে রাতে হরিমন্দির প্রাঙ্গণে ‘শ্রীরাধার মানভঞ্জন’ পালায় গিরিবালা চোখের জলে ভিজিয়ে দেয় দশ গ্রামের মানুষজনকে। কথাকার কিশোরের সে রাতে মনে হয়েছিল, ‘ছুটে গিয়ে একটু ছুঁয়ে দেখি, অভিমানিনী রাধার মানভঞ্জন করে বলি: তোলো মুখ, মোছো আঁখিজল, লো মানিনী— আমিই বংশীধারী শ্রীহরি...’। সেই গিরিবালা একদিন অধিকারীমশাই, কাঠ-মহাজন হয়ে ‘বাজারিয়া মেয়েমানুষ’। এর সঙ্গেই ব্যক্তি-সামাজিক সমস্ত সম্পর্ক গুলিয়ে যেতে থাকে। বাস থেকে নেমে পড়ন্তবেলায় গিরিবালা যখন হাটতলায় গাঁ-মুখো গরুর গাড়ির সন্ধান করে, পড়শিগাঁয়ের কেউ রাজি হয় না তাকে নিয়ে যেতে। যে তিন কিশোর হরিমন্দির প্রাঙ্গণে গিরিবালায় দেখেছিল শ্রীরাধাকে, তারাও পালিয়ে বেড়ায়। সবারই কলঙ্কের ভয়। কিন্তু সেই ভয়-জড়তার মাঝে গিরিবালা ঠিকই তার জায়গা খুঁজে নেয়, কখনও খানিক চতুরতায় কখনও মানুষজনের শেষ মুহূর্তের বিবেকবোধে। এ দুয়ের মাঝে এক হিমেল রাতে কথক কিশোর গঞ্জের এক রাতের আস্তানায় গিরিবালাকে ঘর ছেড়ে দিয়ে রাত কাটায় বারান্দায়। ভোর রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, ‘কখন যে পশ্চিমের সাঁঝতারা হয়ে গেল পুবের পোহাতারা, জ্বলজ্বলে শুক্র শুকতারা হল কখন— কে যে কখন কী হয়ে যায়, কার মনে যে কী আছে— কিছুই টের পাই না, টের পাই না।’

‘নওটংকি’তে এক সাধুর আশীর্বাদে ফুলমোতিয়া বাঁচে তিন দিদির পর, কিন্তু মা প্রসবকালে মারা যায়। মেয়েটি বড় হতে থাকে খেতমজুর বাবার কাছে। ভঁইশ, ছাগল, গরু, ভেড়া চরাতে যায় গাঁওয়ালি সহেলিদের সঙ্গে। তা দেখে মাস্টারজি প্রাইমারি ইস্কুলে ভর্তি করে নেয়, কিন্তু ঘর আর বাইরের টানাপড়েনে তা বিশেষ এগোয় না। তখন রাজা-রানি-নাচনি সেজে নওটংকি, ভঁইশ-বখরির যত্ন, ঘর-দোর পরিষ্কার ইত্যাদিতে শৈশব গড়ায় ছোট ছোট আনন্দ-সহ। বাবা বাসুদেব গোপ কোলিয়ারিতে গিয়ে দুধ বেচে বাড়তি কিছু উপার্জনও করে। কিন্তু বাসের ছাদ থেকে দুধের ক্যান সমেত পড়ে যায় বাসুদেব। ভিটে ছেড়ে ফুলমোতিয়ার আশ্রয় সহেলি বিন্ধিয়াদের টোলায় গৃহপালিত প্রাণীগুলি সমেত। আবার এক সময় ফেরে নিজের ঘরে নতুন করে শুরুর প্রচেষ্টায়। কিন্তু জন্মকালে সাধুর কাছে কথা দেওয়া ছিল এ-মেয়ে বাঁচলে গয়াসুরের সঙ্গে বিয়ে দেবে। চাচা-চাচি সেই সাধুকে নিয়ে দোরে উপস্থিত। সাধু মেয়েটির দখল নেবে, অন্যরা বোধহয় ভঁইশ, গরু, ছাগল, ভেড়া, বাবলাগাছ, ভিটে।

বইটিতে এই নানান হারিয়ে যাওয়ার কাহিনিই লিখেছেন নলিনী। তৃতীয় উপন্যাস ‘ছোট পিসিমা ও আমাদের একান্নবর্তী পরিবার’-এ মানসিক ভারসাম্যহীন পিসিমা হারিয়ে যায়। চতুর্থ কাহিনি ‘‘বৈশাখীর চর ও একটি ‘জলোদ্ভব’ দেশ’’-এ নতুন জেগে ওঠা তীরভূমি ক্ষমতাবানেরা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। গিরিবালা, ফুলমোতিয়া, ছোট পিসিমা আর পুলিনভূমি ভিন্ন ভিন্ন চারটি উপন্যাসের অন্তর্গত কিন্তু ভাবনায়, হয়তো সমাজ-অর্থনীতির নিয়মেও, এই চারটিই এক সূত্রে বাঁধা।

সৈকতের উপন্যাস স্তিমিত রণতূর্য শাঁখারিদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে। পটভূমি বাঁকুড়া জেলার হাটগ্রাম, যেখানে প্রায় হাজার চারেক মানুষ এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। তারা শাঁখা, আংটি, মান্তাসা, পাতিখিলানের মতো অলঙ্কার বানায় পরম মমত্বে ও কুশলতায়, কিন্তু তাদের জীবন শ্রীহীন বিবর্ণ। তারই এক কথাচিত্র উপন্যাসের শুরুতেই, ‘গোধূলির আলো বড় ম্লান ও বিষণ্ণ। যেন একবুক ক্লান্তি নিয়ে সেই আলো এখন আছড়ে পড়ছে হাটগাঁয়ের সীমানায়।’

কিন্তু প্রকৃতি তার আপন নিয়মে দিনান্তের ক্লান্তি ভুলে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে দিনপ্রাতে। তখন কুশকরাতের কুর্র্র্-কুট ধ্বনি শাঁখারিপাড়া জুড়ে। বেলা বাড়লে উত্‌কল পাইকাররা আসে মালপত্র কিনতে। সবাই যে সরাসরি পাইকারদের কাছে কেনে তা নয়, অনেকে কাজের বিনিময়ে মহাজনের কাছ থেকে শুধু মজুরি পায়। আবার কেউ কেউ শাঁখের মুখ ও লেজ অংশের ছাঁট ‘ছালি’ ও ‘পাতা’ বেচাকেনা করে। এ-সব মানুষজনের ভেতর একটি সংসার হল তেলুচরণ আর অন্নপূর্ণার। তাদের ঘরে বারান্দা আছে, মাথায় আচ্ছাদনও আছে, কিন্তু গৃহস্থের দৈনন্দিনের মতো তা ছিদ্রময়, অন্নপূর্ণার শরীরের মতো ভাঙাচোরা। পড়শি আর একটি ঘর বিধবা সরমার যে মেয়ে শিলীকে নিয়ে শাঁখের ছাঁট জুড়ে-জুড়ে ‘গেনি চুড়ি’ বানায়। এই বিড়ম্বিত জীবনের ভেতর দু-একটি আকস্মিক ঘটনা খানিক উত্তেজনা জোগায়। তারই একটি হরিবোল মন্দিরের পাশে আরতির মা পারুলের ওপর কালীর ভর হওয়া। প্রাইমারি ইস্কুলের শিক্ষক বংশীর পরামর্শে শুরু হয় কালীপুজোর তোড়জোড়। যত বেলা বাড়ে, তত উপচে পড়ে ভিড়। তা থেকে পাকা মন্দিরের চিন্তা এবং সঙ্গে বিদ্যুতের আলোও। লাক্ষার খুচরো ব্যবসাদার কিষ্ট কুণ্ডুর মুখ থেকে তখন জানা যায় যে, হাটগ্রামে বিদ্যুত্‌ ঢুকছে দিন পনেরোর ভেতর।

বিদ্যুত্‌ আসার সঙ্গে সঙ্গে মহাজনের ঘরে বসে শাঁখ চেরাই মেশিন। যন্ত্র মুহূর্তে গোটা-গোটা শাঁখ কেটে ফাঁক করে দেয়। এত দিনের গ্রামীণ কৃত্‌কৌশল সেকেলে হয়ে যায় অচিরেই। এর বিপরীতে অন্য এক আশ্বাস— সরকার থেকে কম দামে কাঁচামাল জোগান দিয়ে শঙ্খশিল্পীদের সাহায্য করা হবে। সে মালের দাম নির্ধারিত হয় বাজার দরের এক-তৃতীয়াংশেরও কম। অন্য দিকে, হাওড়ার বাগনান কিংবা কলকাতার রাজা রামমোহন সরণির পরিবর্তে শাঁখ মিলবে জেলা পরিষদের অফিস থেকে। এমনই এক পর্বে তেলুচরণ ছ’শো টাকা দিয়ে নতুন করাত কিনে আনে বর্ধমান জেলার দীননাথপুর থেকে।

সরকার বাহাদুর নিত্য নতুন কর্মসূচির ঘোষণায় এক অর্থে দীননাথ, কিন্তু তার অনেক পরিকল্পনার মতো শাঁখ সরবরাহও ভেস্তে যায়। বস্তা খুলে দেখা যায় নব্বই শতাংশ শাঁখ দাগি, পোকালাগা আর ভাঙা। ফলে ফের মহাজনের কাছে। ওদিকে মহাজনেরাও একে একে চারটি মেশিন নামিয়ে ফেলে। সরকারের পরবর্তী পরিকল্পনায় দরিদ্র শঙ্খশিল্পীদের ঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু তা সবাই যে পায় তা নয়। মহাজনদের লোকজনও এর ভেতর ঢুকে পড়ে এবং লোনের টাকায় সুদ খাটায়। সে-সবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মহাজনের হাতে মার খায় বলরাম। অন্য দিকে, বাজারে লোনের টাকা আসায় মহাজনরা বাড়িয়ে দেয় কাঁচামালের দাম। তার সঙ্গে মহাজনদের মেশিন পাল্লা দিতে পারে, কিন্তু দুঃস্থ শঙ্খশিল্পীরা পারে না। অন্য দিকে, মহাজন পুঁজিবল থেকে পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় আসে। তখন বিধবার ঘরে রাত্রে অনুপ্রবেশ, প্রতিবাদীর প্রাণনাশ। বউয়ের চিকিত্‌সার জন্য তেলুচরণ কুশকরাত বেচতে গিয়ে দেখে তার ছ’শো টাকার নতুন কুশকরাত দু’শো টাকাতেও বিকোয় না। উপন্যাসের শেষে মেলে শাঁখাগ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের অনাহারে উপবাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আশ্বাস।

এই সব ভাঙাচোরা জীবনের কাহিনি নির্মাণে নলিনী ও সৈকতের সম্পদ তাঁদের অভিজ্ঞতা। উপন্যাসের সন্ধানে জীবনের খোঁজখবর নয়, চেনা জীবনকে তাঁরা বিষয় করে তুলেছেন। সঙ্গে রয়েছে দুজনেরই নিজস্ব কাহিনিগদ্য, যা নিছক ভাসায় না, ভাবায়, ভারাক্রান্তও করে।

nalini bera saikat rakshit ramkumar mukhopadhyay book review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy