Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

ন্যায়ের দাবি বড় না নীতির অধিকার

১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর, এই পুরস্কার তাঁর কোন কৃতিত্বের জন্য দেওয়া হল, তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ছিল প্রবল বিভ্রান্তি। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু মজা করে বলেছিলেন, এর জন্য অধ্যাপক সেনই দায়ী। তিনি এত স্বচ্ছন্দে এত বিষয়ে লিখেছেন যে, সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্ত হতেই পারে। সেই উত্তেজিত সময়ে আমাদের রাজ্যেও বিদ্যাচর্চার বাইরের জগতের অধিবাসীরা আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর আসল অবদানটা কী, সেটা বুঝতে।

দিলীপ ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর, এই পুরস্কার তাঁর কোন কৃতিত্বের জন্য দেওয়া হল, তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ছিল প্রবল বিভ্রান্তি। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু মজা করে বলেছিলেন, এর জন্য অধ্যাপক সেনই দায়ী। তিনি এত স্বচ্ছন্দে এত বিষয়ে লিখেছেন যে, সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্ত হতেই পারে। সেই উত্তেজিত সময়ে আমাদের রাজ্যেও বিদ্যাচর্চার বাইরের জগতের অধিবাসীরা আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর আসল অবদানটা কী, সেটা বুঝতে। তখনও পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত রচনার অধিকাংশই ইংরেজিতে, ভবতোষ দত্ত ও অশোক রুদ্রের নেতৃত্বে অনূদিত এক সংকলন বাদ দিলে।

পরে তাঁর বেশ ক’টি বইয়ের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেই ধারাতেই আমরা পেলাম ২০০৯ সালে প্রকাশিত আইডিয়া অব জাস্টিস-এর বাংলা সংস্করণ নীতি ও ন্যায্যতা। সম্পাদকীয় নিবেদনে জানা গেল, ‘‘কারও কারও এই আপত্তি ছিল এই যে এ বইয়ের বিষয়টা বাংলায় প্রকাশযোগ্য নয়। তাঁদের মতে, ‘যদি কেউ এটা বাংলায় পড়েনও, তা হলে পাশে ইংরেজিটা রেখে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়তে হবে।’’ অমর্ত্য সেন অবশ্য একাধিক বার জানিয়েছেন, বাংলা তাঁর ‘প্রথম ও প্রধান’ ভাষা। তাঁর বাংলা ভাষণ বা কথোপকথন যেটুকু শোনা গেছে, তাতে তিনি যে বাংলায় জ্ঞানচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্যের উত্তরসূরি, সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। সংস্কৃতও তাঁর আয়ত্ত। তাঁর বাংলা বইগুলির মধ্যে তর্কপ্রিয় ভারতীয়-তে এই ধারার অনুবাদের কিছু আভাস ছিল। নীতি ও ন্যায্যতা তাকে পূর্ণ রূপ দিল।

সম্পাদকদ্বয় জানিয়েছেন, ‘রূপান্তর নয়’, গ্রন্থের ‘অন্তর্নিহিত চিন্তাকে বাংলায় একটা কাঠামোতে’ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন তাঁরা। ন’জন আলাদা অনুবাদক, কিন্তু বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যে ভাষাশৈলীর তারতম্য বিশেষ নেই। অনেক সময় একটি ইংরেজি বাক্য অনুদিত হয়েছে দু’টি আলাদা বাংলা বাক্যে, কখনও দু’টি বাক্য একত্র হয়েছে। বাংলা ভাষার পায়ে ইংরেজি চলনের বেড়ি পরেনি। ‘মিলিয়ে’ পড়তে হয় না। গদ্য পদ্য দুইই সাবলীল। অ্যাডাম স্মিথকে নিয়ে স্টিফেন লিকক-এর একটি ছড়া:

অভিযোগ শোনো অ্যাডাম স্মিথ
বলোনি কি তুমি ক্লাস লেকচারে
স্বার্থপরতা লাভের হিত
যত মত আছে— তোমার কথায়
সব সেরা তার
আত্মহিত
বলোনি, বলোনি, অ্যাডাম স্মিথ?”

(Adam, Adam, Adam Smith
Listen what I charge you with!
Didn’t you say/ In a class one day
That selfishness was bound to pay?
Of all doctrines that was the Pith.
Wasn’t it, wasn’t it, wasn’t it, Smith?
)
এই সঙ্গে পাওয়া গেছে কিছু জরুরি পরিভাষা, যার বেশ কয়েকটা অমর্ত্য সেনের নিজস্ব অবদান।

গ্রন্থের মূল বিষয় ‘জাস্টিস’, ধ্রুপদী সংস্কৃতে যা দু’টি ভিন্ন শব্দে প্রকাশিত হয়, ‘জাস্টিস’-এর দু’টি আলাদা ধারা বোঝাতে। একটি ‘নীতি’, যা ব্যবহৃত হয় ‘যথোচিত প্রতিষ্ঠান বা যথাযথ আচরণের ধর্ম’ অর্থে; অপরটি ‘ন্যায়’, যা সমাজটা ‘বাস্তবে কেমন দাঁড়াচ্ছে’, নীতির প্রয়োগের পরিণাম সামগ্রিক ভাবে কতটা ন্যায্য, সেই ধারণা দেয়।

আলোচনার চারটি পর্ব: ‘ন্যায্যতার দাবি’, ‘যুক্তিপ্রয়োগের বিভিন্ন রূপ’, ‘ন্যায্যতার রসদ’ এবং ‘প্রকাশ্য যুক্তিপ্রয়োগ ও গণতন্ত্র’। সম্পাদকীয় নিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ন্যায় আর নীতির ধারণা দু’টির প্রতিদ্বন্দ্বিতাই এই বইয়ের একটি মৌলিক বিষয়।’ এই বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপটে চিত্রিত হয়েছে আরও অনেক তত্ত্ব ও ধারণার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তির, মুক্ত নিষ্পক্ষতার সঙ্গে বদ্ধ নিষ্পক্ষতার, অবস্থানগত নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক বিভ্রমের, বিচারসঙ্গত চয়নের সঙ্গে সামাজিক চয়নের, সহানুভূতির সঙ্গে দায়বদ্ধতার, সর্বাঙ্গীণ ফলাফলের সঙ্গে সর্বশেষ ফলাফলের, স্বক্ষমতার সঙ্গে স্বাধিকারের, বিশ্ব ন্যায্যতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ন্যায্যতার। সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে লেখক পাঠককে পরিচিত করান দেশ-কালে ব্যাপ্ত ন্যায্যতার বহুবিধ ধারণার সঙ্গে। আর একটি বড় পাওনা হল ন্যায্যতার সন্ধানে সামাজিক চয়ন তত্ত্বের প্রয়োগ: ‘সাধারণ বুদ্ধি যে ভাবে অগ্রসর হতে বলে, এই ধারার বিচারপদ্ধতি এবং তাঁর অন্তর্নিহিত যুক্তিগুলি তার বেশ কাছাকাছি।’ এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেছেন গ্রামশির উক্তি: ‘এটা দেখানো প্রয়োজন যে সব মানুষই দার্শনিক।’ নীতি ও ন্যায্যতার সম্পর্কের কথায় মনে পড়তে পারে ভারতে দরিদ্র-তালিকার বিবর্তনের ইতিহাস— ন্যায্যতার দাবি অনেক বারই নীতি বদলাতে বাধ্য করেছে সরকারকে।

নীতিভিত্তিক তত্ত্বের ইদানীং কালের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা জন রল্স-এর তত্ত্বের সশ্রদ্ধ বিরোধিতার যুক্তিগুলো পড়তে গিয়ে মনে পড়তেই পারে রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীজির পত্রালাপ। সেখানেও শ্রদ্ধা আর বিরুদ্ধ সমালোচনার বিরল সংমিশ্রণ পেয়েছিলাম আমরা। রলসের সঙ্গে একত্রে অধ্যাপনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অমর্ত্য জানিয়েছেন, “আমার নিজের কাজের ধারা অন্য খাতে প্রবাহিত হয়েছে, আমার সিদ্ধান্তগুলিও স্বতন্ত্র। কিন্তু আমি যে ভাবে ন্যায্যতাকে বুঝি, তার জন্য আজও আমি রল্সের কিছু মৌলিক ধারণার কাছে ঋণী।” বইটি রলসেকেই উৎসর্গ করেছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE