প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৮ জুলাই ১৯১৪ সালে। এ বছর তার শতবর্ষ পূর্ণ হল। চার বছর চলেছিল এই যুদ্ধ। এই যুদ্ধের প্রধান অবদান এটাই যে তা যুদ্ধের প্রযুক্তি, হিংসা ও সন্ত্রাসকে বিশ্বায়িত করেছিল। নিহত হয়েছিল আশি লক্ষেরও বেশি মানুষ। তার পর থেকে বিশ্বায়িত যুদ্ধ, হিংসা ও সন্ত্রাসের প্রক্রিয়া কখনও থামেনি।
এই শতবর্ষকে স্মরণে রেখে গ্যালারি কলকাতায় আয়োজিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী যার শিরোনাম ‘ওয়ার অর পিস?’। এতে অংশ নিয়েছেন ১৭ জন শিল্পী।
ছত্রপতি দত্তের ইনস্টলেশনটির শিরোনাম ‘মেমোরিয়াল— লেটার্স রিটেন হোম’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সুদূর বিদেশে লড়াই করতে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রায় দশ লক্ষাধিক ভারতবাসী। তাঁদের অনেকেই নিহত হয়েছেন। তাঁদের অনেকে দেশে তাঁদের পরিজন ও বন্ধুদের চিঠি লিখেছেন। ছত্রপতি সেই মৃত সৈনিকদের স্মৃতিতে তৈরি করেছেন কাল্পনিক স্মৃতিস্তম্ভ। তার উপর ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঝোলানো হয়েছে বিভিন্ন চিঠির টুকরো অংশ। বড় মর্মান্তিক ছিল সে সব চিঠির বয়ান। যেমন একজন সৈনিক লিখছেন, তিনি যদি চার বছরেও ঘরে না ফিরতে পারেন তা হলে তাঁর স্ত্রী অন্য কোনও পুরুষের সংসর্গে সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। কেননা বংশরক্ষা খুবই জরুরি। এই স্মৃতিস্তম্ভের সামনে রাখা হয়েছে চিতা-সদৃশ একটি শুকনো কাঠের কাঠামো। তার উপর রয়েছে বিশালকায় একটি মৃত জন্তুর বিস্তৃত দুটি শিং। মৃত্যুর প্রতীক।
শমীন্দ্রনাথ মজুমদারের ইনস্টলেশনটির শিরোনাম ‘ওয়ার সনেট’। দেয়াল জুড়ে পুরোনো কাঠের স্ট্রাকচার গড়েছেন। সনেটের পঙক্তিবিন্যাসের মতো আট ও ছয় লাইনের দুটি স্তবক সাজিয়েছেন। শব্দের ধ্বনিকে দৃশ্যতায় রূপান্তরিত করেছেন সমান্তরাল ভাবে সংস্থাপিত সেই কাঠের বিন্যাসে। শমীন্দ্র আর একটি বড় পরিমাপের বিমূর্ত ছবিও করেছেন। যার শিরোনাম ‘ইট অলওয়েজ হ্যাপেনস টু আদার পিপ্ল’। অদীপ দত্ত এঁকেছেন দশ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি কাঁটাতার।
দেবাঞ্জন রায়ের ইনস্টলেশনটির শিরোনাম ‘অ্যাবসেন্স অব বাপু’। মহাত্মা গাঁধীর অনুপস্থিতিতে তাঁর শুভ্র শূন্য আসন বা বিছানাটি পড়ে আছে। পাশে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন সৈনিক। পলা সেনগুপ্তের ছাপচিত্র ও সুতোর কাজের সমন্বয়ে করা দুটি রচনায় ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন অনুষঙ্গ রূপায়িত হয়েছে মানবীসৃষ্ট মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। গাঁধীর প্রকৃত রূপারোপ নিয়ে ছবি করেছেন মুম্বইয়ের বিবেক শর্মাও। হিংসা ও অহিংসার দ্বান্দ্বিকতা তাঁর ছবিটিরও মূল উপজীব্য।
অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের ক্যানভাসের উপর চারকোলে করা ছবির শিরোনাম ‘দ্য ক্র্যাড্ল’। বধ্যভূমি থেকে মৃতদেহ তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মূর্ত ও বিমূর্তের অসামান্য সমন্বয় ছবিটি। শান্তির বনাঞ্চলেও জ্বলছে হিংসার আগুন। এ রকম প্রতিমাকল্প এঁকেছেন চন্দ্র ভট্টাচার্য ‘অ্যান ইলিউশন অব পিস’ শীর্ষক অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে। সমীর রায়ের ‘ফ্রোজেন হোমেজ’ ও ‘রেমনস্ট্রেশন’ মিশ্রমাধ্যমে করা অসামান্য নির্মাণ। ধ্বংসকেই মূর্ত-বিমূর্তের সমন্বিত রূপকল্পে রূপ দিয়েছেন রবীন রায় ‘ডেস্ট্রাকশন’ শিরোনামের দুটি রচনায়। শিপ্রা ভট্টাচার্যের অনামা বর্ণিল ক্যানভাস দুটির একটি অবয়বী-নাটকীয়তায় সংহত। অন্যটি নিরবয়বের মধ্যে বলিষ্ঠ নির্মাণ। হিংসা-অহিংসার টানাপড়েনের সুরটিকে ধরতে চেয়েছেন তিনি। একই সুর অনুরণিত হয় পার্থপ্রতিম দেবের রচনা দুটিতেও। ভালবাসা ও হিংসার বুনোটকে নিবিড় নিষ্ঠায় রূপায়িত করেছেন স্বপনকুমার মল্লিক। টুকরো টুকরো ড্রয়িং-নির্ভর ছোট ছবি একত্রিত করে নিজস্ব শ্লেষাত্মক নিম্নবর্গীয় ভাষায় সর্বগ্রাসী বিপর্যয়ের প্রতীকী ভাষ্য রচনা করেছেন তিনি।
হিংসা ও শান্তির দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতীকী ভাষ্য রচনা করেছেন অশোক ভৌমিক। ভালবাসারই জয় হয় শেষ পর্যন্ত এই ভাবনা ব্যক্ত করেছেন শান্তনুু মাইতি তাঁর একটি ক্যানভাসে। এই শান্তিরই অভীপ্সা কাঞ্চন দাশগুপ্তের একটি তেলরঙের ক্যানভাসেও। আকাশে উড়ন্ত পায়রার ঝাঁক, সে দিকে তাকিয়ে আছে এক মানবী। জয়শ্রী চক্রবর্তীর মতো গভীর মননের শিল্পী কেন ১৯১২-তে করা সাধারণ মানের একটি ছোট ছবি দিলেন, এই প্রশ্ন থেকে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy