Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

মানুষের অন্তর্গত আলো এখনও নেভেনি

মান্য প্রকাশকের সশ্রদ্ধ উদ্যমে অশীতিবর্ষস্পর্শী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ৮১৩ পৃষ্ঠার কবিতা সমগ্র প্রকাশ বঙ্গীয় সংস্কৃতি-জগতে এক বিশেষ ঘটনা। প্রত্যক্ষত যিনি এক জন মঞ্চ ও রজতপটের সফল অভিনেতা তাঁর অনতিপ্রচ্ছন্ন দীর্ঘকালের কবিতাজীবনের এক সনিষ্ঠ যাপনচিত্র বইটি সম্ভ্রম সহকারে উপস্থাপন করেছে। বিশ্লেষণে সুধীর চক্রবর্তী।

সুধীর চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৪ ০০:০২
Share: Save:

মান্য প্রকাশকের সশ্রদ্ধ উদ্যমে অশীতিবর্ষস্পর্শী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ৮১৩ পৃষ্ঠার কবিতা সমগ্র প্রকাশ বঙ্গীয় সংস্কৃতি-জগতে এক বিশেষ ঘটনা। প্রত্যক্ষত যিনি এক জন মঞ্চ ও রজতপটের সফল অভিনেতা তাঁর অনতিপ্রচ্ছন্ন দীর্ঘকালের কবিতাজীবনের এক সনিষ্ঠ যাপনচিত্র বইটি সম্ভ্রম সহকারে উপস্থাপন করেছে। আধুনিক পৃথিবীতে এমন উদাহরণ সংখ্যাল্প হলেও বিরল নয় যে সম্পন্ন শিল্পীমনের সমৃদ্ধি যাঁর থাকে, তাঁর উদ্ভাসনের প্রক্রিয়ায় সমান্তরাল দ্বিমুখী বা বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় আমরা পাই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সৌমিত্র কখনওই নিছক হরবোলা অভিনেতা নন। তিনি কবি, সম্পাদক, অনুবাদক, নাটক রচয়িতা, নাট্য পরিচালক, বাচিক শিল্পী ও মননপ্রকর্ষে উজ্জ্বল এক প্রগতিচেতন ব্যক্তিত্ব। অথচ এত সব বিচিত্রমুখী প্রকাশধারার ভেতরে ভেতরে তাঁর রয়েছে বহু দিনের কাব্যফল্গুর অন্তঃস্রোত, যা ১৯৭৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বারোটি কাব্যগ্রন্থে নানা রূপে বর্ণে ছন্দে ধরা আছে। মাঝখানে ১৯৯৮ সালে বেরিয়েছে খলিল জিব্রানের দ্য প্রফেট নামের ব্যতিক্রমী কাব্যের অনুবাদ, যার নাম ‘দ্রষ্টা’। এর পাশে কাব্য সংগ্রহে অন্য রঙ-রূপের জেল্লা এনেছে ১৯৯৮-এর ‘নাতি-

নাতনির ছড়া’ আর ১৯৯৯-এর ‘ছড়া সংগ্রহ’। বইয়ের সব ক’টি রচনা পাঠ করলে বোঝা যাবে, এই বারোটি ক্রমান্বিত কাব্য সংকলনে আছে সৌমিত্র-র আত্মভাষা সন্ধান ও আত্মোদ্ঘাটনের আকুতি আর ছড়া সংগ্রহে ফুটে উঠেছে তাঁর পরিবারজীবন ঘেরা হালকা খেয়ালখেলার আঁকিবুকি। খলিল জিব্রানের কাব্য অনুবাদ চেষ্টা তাঁর বৃহত্তর কুতূহলী মননের স্বরলিপি। সব মিলিয়ে সমগ্র এক গভীরতামুখী সমাজচেতন প্রকাশোন্মুখ ব্যক্তির চারিত্রমূর্তি এখানে সজীব। তার প্রতিটি ঝংকার যে আমাদের মতো জীবনপ্রান্তবাসীদের হৃদয়তারে অনুরণন তোলে তার কারণ সৌমিত্র যে সমকালীনতার অভিজ্ঞতায় জারিত। দেশ কাল সমাজ বাস্তবতা ও স্বপ্নবীজের টানাপড়েনে বোনা তাঁর ঘটমান জীবনধারা। সারা বইতে ধরা পড়েছে রবীন্দ্র-পরিসর পেরিয়ে দ্যুতিমান এক স্বতন্ত্র ‘সত্যজিতের কাল’। সেই চলচ্চিত্রকারের নিকট সান্নিধ্য ও স্ফুটমান যৌবনদিনে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর মেধাবী সঙ্গ এই কবি-ব্যক্তিত্বের সৃজনবীণার তার টানটান করে বেঁধে দিয়েছে। চিনিয়েছে পরিপার্শ্বের শ্রী ও শোভনতা, মগ্ন করেছে নিসর্গ লোলুপতায় আর প্রেমের টানে ও আত্মবীক্ষায়। সুদীর্ঘ সফল সৃষ্টিসুন্দর নানা শিল্পসংরাগে উজ্জ্বল করেছে নিসর্গ লোলুপতায় আর প্রেমের টানে ও আত্মবীক্ষায়। সুদীর্ঘ সফল সৃষ্টিসুন্দর নানা শিল্পসংরাগে উজ্জ্বল জীবন পরিক্রমার পরেও তাঁকে বলে যেতে হয়:
সাধ চলে যায়
সাধের আসনখানি পড়ে থাকে
সাধও নেই কেউ এসে বসুক সেখানে।

এই মৌলিক বেদনাবোধ তাঁর কবিতার বেশ সাবলীল সূত্র, তাতে আত্মপ্রবঞ্চনার মহত্ত্ব স্থান পায়নি, বড় হয়ে উঠেছে অভিজ্ঞতার তাপ। তাঁর কবিভাষা ও অন্তর্লীন ব্যথাতুর সত্তা তাঁর নিজেরই অর্জন। তাতে কোনও অভিনয় কারুকুশলতার ভান নেই। মেকআপ বর্জিত, অন্যের সংলাপ না-আওড়ানো, অন্যের চরিত্রায়নের বাধ্যতা ত্যাগ করে কবিতা সমগ্র পেশ করে এক প্রকৃত সৌমিত্র-র মুখচ্ছদ। যা তাপিত, তৃপ্ত ও বৎসল একই সঙ্গে।

এখানে মনে রাখা চাই যে, যাঁর জন্মসাল ১৯৩৫, তাঁকে তো জন্মেই দেখতে হয়েছে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমির নানা চেহারা— বিশ্বযুদ্ধ, বিপ্লব, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ আর স্বাধীনতা। গড়ে ওঠার কালে দেখা এত সব দাগ যেন স্মৃতির কোলাজের মতো পরাক্রান্ত চাপ ও ছাপ রাখে। সেই সব নিয়েই তবু তাকে পেরিয়ে তো এই কবির প্রকৃত অভিমুখ সন্ধানের চাঞ্চল্য। কবিতা সমগ্র-র ভূমিকায় কবি নিজেই কবুল করে বলেছেন: ‘সামান্য ভাবে হলেও কবিতা-লেখকের জীবনধারণের একটা পরিচয় হয়তো এই কবিতা সমগ্র বহন করছে।’ তাঁর আরেকটি ঘোষণা যে: ‘আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম কৈশোরের নতুন জন্মানো প্রেমাকাঙ্ক্ষার আন্দোলনে। তাই প্রেমের আনন্দ বেদনা ব্যর্থতা চরিতার্থতাই বোধহয় আমার সমস্ত জীবনভর কবিতার সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী স্রোত হয়ে থেকে গেছে।’... ‘পরবর্তী কালে অবশ্য একটু একটু করে প্রকৃতি, সমাজ, বেঁচে থাকার অপরিহার্য অভিজ্ঞতাগুলি কবিতার মধ্যে একটু একটু করে ফুটে উঠতে আরম্ভ হল।’

এ রকম অনুভবলব্ধ কথাগুলি কোনও অভিনেতার নয়, একজন কবির জবানি, যাঁকে স্পর্শ করে আছে এক তারুণ্য— অভিনয়ের অন্তরালে জেগে থাকা কবোষ্ণ বোধের দীপ্তি। আমার মতো সৌমিত্রের সমবয়সিদের জানা আছে যে, কবিতা রচনা তাঁর ব্যসন নয়, বরং বহু কালের অভ্যাস। যখন চলচ্চিত্র জগতের ডাক আসেনি, সেই পঞ্চাশের দশকের উত্তাল সময়ে সৌমিত্র আমাদের সামনে তাঁর কবিতার খাতা খুলে, পরম ভালবাসায় শোনাতেন একের পর এক নতুন লেখা কবিতা। পরে, ব্যস্ত কাজের দৈনন্দিনে, শ্যুটিংয়ের মধ্যে বা তার ফাঁকে বিরল অবকাশে কবিতা তাঁকে গ্রস্ত করেছে বারে বারে, নইলে কি এত কবিতা রচনা আর বারোটি সংকলন সম্ভব হত? নিজস্ব অনুভবের বৃত্ত তাঁর স্বধর্মের অংশ, তাই তাতে কখনও ভাঁটার টান লাগে না। তিনি অনায়াসে বলতে পারেন: ‘সব কথার শিশির শুকিয়ে যায়/ ভালবাসা শিশিরে ভেজানো’। পঞ্চাশ পেরনো বয়সে তাঁর মনে হয়:
এ সব কবিতা আমি লিখে যাই প্ররোচনা ব্যতিরেকে
সহজেই, যেমনটি খসে পড়ে অঘ্রানের রাতে
চালের খড়ের থেকে শিশিরেরা টুপটাপ
লক্ষ্যহীন— অলক্ষিত — অবলোকনের থেকে দূরে
”।
তাই বলে এর মধ্যে কি আমরা কবির গূঢ় অভিমানের বাচন খুঁজতে পারি? সৌমিত্র-র কবিতা চর্চা তথা কবিতারাজ্যে পরিক্রমা কোনও অর্থেই লক্ষ্যহীন নিশ্চিত নয়, তবে পাঠক ও বঙ্গীয় কবিসংসারে কবি সৌমিত্র তো অলক্ষিত বটেই, অবলোকনেরও কি বাইরে? তাতে অবশ্য খুব একটা কিছু এসে যায় না কেননা, তাঁর উপজীব্য হল মানুষ। ভরসার কথা এটাই যে, “মানুষেরই সঙ্গে থাকা ভালো ব’লে/ কেউ গিয়ে থাকে না জঙ্গলে একা একা—।” এই মানব সন্নিধানে তিনি বোঝেন মানুষের অন্তর্গত আলো এখনও নেভেনি।

যাঁরা সক্রিয় কর্মী আর সৃজনাবেগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, তাদের ভিতরে এসে যায় উপচীয়মান হৃদয়সম্পদের জোয়ার, আসে উদ্বৃত্ত স্বপ্ন-কল্পনার সম্পদ। মঞ্চে ও স্টুডিয়ো-য় সদা তৎপর সৌমিত্র এই আন্তর শক্তির টানে নিরন্তর কবিতা লিখে যান। কিং লিয়ারের মতো কিন্তু তাতে কোনও ক্লান্তি আসে না। অস্তায়মান জীবন-পরিধির প্রান্তে এসে তাই তাঁর আত্মজিজ্ঞাসা—
এত কিছু অসমাপ্ত অবিন্যস্ত রেখে যাচ্ছ
চিত্ররচনায় এতখানি ক্যানভাস খালি রয়ে গেল
একি ঠিক হল?

বোঝা যায় এই সফল অভিনেতার অন্তর্জীবন জিজ্ঞাসাজর্জর, প্রশ্নাতুর। চরিতার্থতার অলস আত্মতৃপ্তি ছাপিয়ে তাঁর প্রার্থনা:
আমি সমাধান চাই না তো
এমনকি রোগমুক্তি শান্তি কিংবা সুখ
শুধু এক বরাভয় চাই তারই অনুদ্বিগ্ন মুখ
’।
কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। কেননা, মৃত্যুর অনিবার্য থাবা একে একে কেড়ে নিচ্ছে প্রিয়জনদের, বন্ধুবৃত্তে টান পড়ে। তখন বলতেই হয়:
একে একে চেনা যারা চলে যায়
যতটা নিঃসঙ্গ হয়
মৃত্যু ততটাই তার কাছে আসে
পাশাপাশি হাঁটে।

এমনতর একান্ত অর্জিত নিঃসঙ্গতা তো কবির, কেননা তিনি যে পরিপার্শ্ব সচেতন, তাই নিজেকে নিয়ে তৃপ্ত আর স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকতে পারেন না। লিখে ফেলেন:
যেদিন ঘেঁসের পাহাড় ভেঙে
কিশোরীর জিন্দাগোর হয়
শিশু মরে দু’নম্বরি ওষুধে
সেদিন ছাপার হরফগুলো ছটফট করতে আরম্ভ করে।

তাঁর কবিতার মধ্যে গাঁথা আছে এমন অনেক প্রতিকারহীন কষ্ট— ছটফট করা এক জন অসহায় মানুষের মন। প্রতি দিন বুঝতে পারেন শহরটা বাসযোগ্য থাকে না, পয়সার দাম নেই, ভাঙাচোরা পথঘাট দীর্ণ দেশকাল, জীর্ণ সব ঘরবাড়ি— এমনকি ‘আমরাই অটুট এখন আর নেই’। তবু কী আশ্চর্য ‘কোলকাতা কিছুতেই ফুরোতে চায় না/ কোনো রাস্তা ফুরোতে চায় না’। আশ্চর্য এও বড় কম নয় যে ‘এতখানি হেঁটে এসে এতখানি বয়সেও আমি কেমন নিশ্চিন্ত হতে পারি সন্ধ্যার মুখোমুখি’। সৌমিত্র তার এক লেখায় এপিটাফের মতো লিখেছেন:
শুধু একবার ছেঁড়া শার্ট খুলে তোমাকে দ্যাখাব
ঝাঁঝরা হওয়া বুকে কতখানি বসন্ত ছিল গাঁথা।

শেষ পর্যন্ত তাই আমাদের মনে হয়, তাঁর কবিতা আসলে প্রগাঢ় নানা স্বীকারোক্তির সন্দর্ভ। তার মধ্যে ভরা আছে সন্তপ্ত এক ভালবাসাপ্রিয় জর্জর আধুনিক মানুষের আর্তস্বর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE