এশিয়ার নদী-বদ্বীপগুলি যুগ যুগ ধরে ক্রমবিবর্তিত হচ্ছে। একদিন গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতের নদী-বদ্বীপ অঞ্চলেই তাঁর নৌবাহিনী নোঙর করিয়েছিলেন সমুদ্রের অববাহিকায়। কিছু দিন আগে প্রবল সুনামির তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে সেই সব বদ্বীপ অঞ্চল। ভারতবর্ষ, চিন ও এশিয়ার বিভিন্ন নদী-তীরবর্তী অঞ্চলেই সুদূর অতীত থেকে গড়ে উঠেছিল বড় বড় সভ্যতা। জলই মানুষ ও প্রকৃতির জীবনধারণের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। সভ্যতার বিবর্তন ও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি যে ভাবে কলুষিত হচ্ছে, সে ভাবে ধ্বংস হচ্ছে জলের সনাতন উত্সগুলি। নদী-অববাহিকাগুলি বিনষ্ট হতে হতে আজ চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। আমরা আমাদের পরিচিত শহর ও গ্রামাঞ্চলেও দেখতে পাই কী ভাবে জলের উত্সগুলিকে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। যে সব অঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরে জলাভূমিতে মাছের চাষ হত বা শস্যের ফলন হত, সেখানে এখন নির্মিত হচ্ছে বড় বড় হাইরাইজ, ছুটে চলেছে বড় বড় হাইওয়ে। প্রকৃতি কত দিন মেনে নেবে সভ্যতার এই অপরিণামদর্শী দুরাচার, এই প্রশ্ন আজ সমস্ত বিবেকবান মানুষের মনে।
দৃশ্যকলায় এই পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রসঙ্গ নানা ভাবে উঠে আসে। সম্প্রতি স্টুডিয়ো ২১-এ অনুষ্ঠিত হল একটি প্রদর্শনী, যার শিরোনাম ‘এনভিশনিং এশিয়াজ ওল্ড ডেলটাজ ইন দ্য এজ অব স্যাটেলাইটস’। এখানে ব-দ্বীপের বিবর্তনের পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে জলের উত্সের এই সমস্যার প্রসঙ্গও। সে অর্থে এটি কোনও চিত্রকলার প্রদর্শনী নয়। মূলত এটি আলোকচিত্রের প্রদর্শনী। কিন্তু এগুলি কোনও প্রথাগত আলোকচিত্রও নয়। অনেক উপর থেকে তোলা হয়েছে বিভিন্ন নদী-অববাহিকা ও ব-দ্বীপ অঞ্চলের ছবি। তার পর তাকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করে উপস্থাপিত করা হয়েছে প্রদর্শ হিসেবে।
শিল্পীর নাম ভিক্টোরিয়া মার্শাল। তিনি এখন নিউইয়র্কের নিউ স্কুল ফর ডিজাইনে আরবান ডিজাইনের সহকারী অধ্যাপক। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারে স্নাতকোত্তর শিক্ষা নিয়েছিলেন। তার পর বিশ্ব জুড়ে বহু পরিবেশ প্রকল্প ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। মার্শাল এখন ‘মেগা ডেল্টা’ নামে একটি বইয়ের উপর কাজ করছেন, যা ভারত ও চিনের দুটি শহরের ‘ইকোলজিক্যাল আরবান ডিজাইন’ বিষয়ে গবেষণার ফসল। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলি হয়তো সেই সূত্রেই তৈরি হয়েছে। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা বা কিউরেট করেছেন নিউইয়র্ক ও বেজিং-ভিত্তিক আর্কিটেকচারাল ডিজাইনার তাং কিনাং।
এই প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে ডিজিটাল প্রিন্টের ১১টি ছবি। প্রথম ছবিটির শিরোনাম ‘দ্য ক্লাউড ড্রয়িং, কলকাতা পেরিফেরি’। ঊর্ধাকাশ থেকে তোলা হয়েছে ছবিটি। আকাশে বিস্তীর্ণ মেঘের সমাবেশ দেখা যাচ্ছে। সেই মেঘ ভেদ করে ভূপৃষ্ঠের ছবি ভেসে ওঠে। এক পাশে ব্যাপ্ত জলের উত্স। আর এক পাশে তীরবর্তী ভূ-ভাগ বিস্তৃত হয়েছে। উপর থেকে ক্ষুদ্রাকারে দেখা যাচ্ছে বনাঞ্চল ও জনবসতি। আমাদের পরিচিত দৃশ্য-বাস্তবের প্রকৃত স্বরূপ আমরা অনুধাবন করতে পারি না, যখন আমরা ভূপৃষ্ঠ থেকে নিসর্গকে দেখি। উপর থেকে দেখলে বিস্তৃত অঞ্চল একসঙ্গে দৃষ্টিগোচর হয়। তখন দৃশ্যের স্বরূপ পাল্টে যায়। ছবি তখন চিত্রেরই এক বিশেষ ধরন হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় ছবিটি চিন দেশের। শিরোনাম ‘দ্য টাইড ড্রয়িং, হাংঝু পেরিফেরি’। উপর থেকে দেখলে মনে হয় পৃথিবীর সব মানচিত্রেই কোথায় একটা সাম্য আছে। নীচে নেমে এলে সেই সাম্যের ভিতর থেকে প্রভেদটা বেরিয়ে আসে। তৃতীয় ছবি ‘ওশেন স্পেস’। সমুদ্রের ব্যাপ্ত পরিসরকে ক্যামেরায় ধরা হয়েছে। এটি হয়ে উঠেছে একটি পরিপূর্ণ বিমূর্ত চিত্র। মূর্তের ভিতরেই যে বিমূর্ত লুকিয়ে থাকে, দেখার প্রেক্ষাপট বদল করলে এই ছবিটি থেকে তা বোঝা যায়। এর পর শিল্পী ভারত ও চিনের অঞ্চলগুলিকে পাশাপাশি উপস্থাপিত করে গেছেন।
এই বিমূর্ততা অতিক্রম করে আমরা আমাদের পরিচিত নিসর্গে ফিরে আসি একটা পর্যায়ে। তখন দেখতে পাই এই বাংলারই পুকুর ও জলার ধারে জীবনের নানা বিন্যাস। গ্রামের লালমাটির পথ চলে গেছে। তার বাঁকের মুখে মুখে বিভিন্ন আকৃতির জলাশয়, কোথাও বা শস্যে ভরা কৃষিজমি। চাষের কাজে ব্যস্ত একাকী এক কৃষক। দূরে দেখা যাচ্ছে হাইরাইজ। নগর গ্রাস করতে আসছে গ্রামকে, গ্রামের জলাশয়কে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy