Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

শোনারও কি দায় নেই আমাদের

সত্তরের দশক শেষমেশ মুক্তির দশক হয়নি। উত্তরবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে উড়ান দিয়েছিল যে কৃষক বিপ্লব, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে অচিরেই ভূমি নিয়েছে সে। তবু, পরের কয়েকটি দশক জুড়ে বারে বারে দেশের নানা প্রান্তে মাথাচাড়া দিয়েছে নকশালবাড়ির উত্তরাধিকার। রচিত হয়েছে নানা আখ্যান কখনও ইতিহাস-নির্ভর ধারাবিবরণী, কখনও স্মৃতিকথা, কখনও কবিতা-গল্প-উপন্যাস।

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

সত্তরের দশক শেষমেশ মুক্তির দশক হয়নি। উত্তরবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে উড়ান দিয়েছিল যে কৃষক বিপ্লব, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে অচিরেই ভূমি নিয়েছে সে। তবু, পরের কয়েকটি দশক জুড়ে বারে বারে দেশের নানা প্রান্তে মাথাচাড়া দিয়েছে নকশালবাড়ির উত্তরাধিকার। রচিত হয়েছে নানা আখ্যান কখনও ইতিহাস-নির্ভর ধারাবিবরণী, কখনও স্মৃতিকথা, কখনও কবিতা-গল্প-উপন্যাস। যেমন, অমিত ভট্টাচার্যের কারাস্মৃতি/সত্তরের মশাল (সেতু, ১২৫.০০)। অধ্যাপক বাবার ছেলে অমিত রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। নকশালবাড়ির কৃষিবিপ্লবের সমর্থনে তখন কলেজের দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে লেখা থাকত: ‘আজ অনুশোচনার দিন নয়, আগুনের মতো জ্বলে ওঠার দিন— কমরেড চারু মজুমদার’। সেই রাজনীতির টানে পড়াশোনা ছেড়ে গৃহত্যাগ অমিতের। নাগাল্যান্ড যাওয়া, ডিমাপুরের জেল, মিসায় আটক, প্রেসিডেন্সি ও আলিপুরের জেলজীবন— এসেছে অনেক কিছুই।

সেই উত্তাল সময়ে চারুবাবু, জঙ্গল সাঁওতালদের সঙ্গে নকশালবাড়ির আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যিনি, প্রবাদপ্রতিম সেই কানু সান্যালের জীবনকথা উনিশটি অধ্যায়ে বিবৃত করেছেন তরুণ সাংবাদিক বাপ্পাদিত্য পাল, তাঁর দ্য ফার্স্ট নকশাল-এ (সেজ, ৫৫০.০০)। মুখবন্ধে বাপ্পা জানিয়েছেন, এর প্রতিটি অধ্যায় কানুবাবু নিজে দেখে অনুমোদন দিয়েছেন। শুধুমাত্র শেষ অধ্যায় ছাড়া। ২০১০-এর ২৩ মার্চ কানুবাবুর মৃত্যুর খবর যখন তাঁর কাছে পৌঁছয়, বাপ্পা তখন শেষ অধ্যায়টি রচনা করছেন। কানুবাবুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বস্তুনিষ্ঠ ভাবে সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবৃত করেছেন তিনি।

তিনি চেয়েছিলেন কবিতার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে। কবিতা এবং রাজনীতি— দুই’ই তাঁর কাছে সমান প্রিয়। তবে তুলনায় কবিতাই তাঁর বেশি প্রিয়— দিনলিপিতে লিখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ। শব্দের সঙ্গে বন্ধুতা করেও তাকে নিয়ে দীর্ঘ জীবন নাড়াচাড়া করতে পারেননি এই তরুণ কবি। তবু, গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতা ও দিনলিপি-র (একুশে, ২০০.০০) পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে জীবনকে তীব্র ভাবে নিংড়ে নেওয়ার প্রয়াস। জেলের মধ্যে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় হুগলির মগরার এই তরুণ কবির ।

অমর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ভিন্ন স্বাদের গ্রন্থ সিম্ফনি অফ স্প্রিং থান্ডার/ইনফ্লুয়েন্স অফ নকশালবাড়ি মুভমেন্ট অন আর্ট অ্যান্ড কালচার (ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকেশন, ২০০.০০)। এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে ষাট ও সত্তর দশকের নাটক, গান, কবিতা, ছায়াছবি, সাহিত্য-সহ নানা বিষয়। লিখেছেন মণিভূষণ ভট্টাচার্য, গৌতম ঘোষ, শৈবাল মিত্র, চণ্ডী লাহিড়ী, নির্মল ব্রহ্মচারী, অসিত বসু, দিলীপ বাগচী, অমল রায়, ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য, অমর ভট্টাচার্য। বিভিন্ন নিবন্ধে নানা দিক থেকে বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণ পাঠককে ভাবনার খোরাক জোগাবে নিঃসন্দেহে।

পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে ক্ষীয়মান বাম আন্দোলন ও নেতৃত্বের দুর্বলতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলেছে। তিতাস দাশগুপ্ত এবং শুভরঞ্জন দাশগুপ্তের সম্পাদনায় ডায়ালগস অন ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড পলিটিক্স অফ দ্য লেফট (ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা) বস্তুত পনেরোটি সাক্ষাত্‌কারের সংকলন গ্রন্থ। দেশ-বিদেশের পনেরো জন ব্যক্তিত্বের ভণিতাহীন সাক্ষাত্‌কার বাম আন্দোলন ও জনগণের থেকে দলের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে নতুন ভাবনা জোগাবে। তালিকায় আছেন শঙ্খ ঘোষ, সুনীল মুন্সি, কবীর সুমন, অমিয় বাগচি, জয়া মিত্র, কৌশিক সেন, সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বামপন্থী নেতা নৃপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক সরকার, পাকিস্তানের মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তথা সঙ্গীতজ্ঞ তাইমুর রাহমান, বামপন্থী তাত্ত্বিক বদরুদ্দিন উমর, নেপালের শ্রীনিবাসন রামানি প্রমুখ। যেমন নৃপেনবাবু বলেছেন, জনগণ ভোট দিয়ে বামেদের ক্ষমতায় এনেছিল, কিন্তু এই নতুন শক্তি জনগণের শক্তি হয়ে উঠতে পারল না।

কালোত্তীর্ণ যে বঞ্চনা নকশালবাড়ির বিদ্রোহের পলতেয় আগুন ধরিয়েছিল, সেই বঞ্চনা আসলে আদি-অনন্ত। নকশালবাড়ি, মালকানগিরি, পলামৌ, লালগড়, নেতাই— স্থান পাল্টায়, কিন্তু তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বিদ্রোহের কার্য-কারণ। এক দল সমাজবিজ্ঞানী জঙ্গলমহল ঘুরে ঘুরে সাম্প্রতিক অতীতের সেই অস্থিরতার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যাখ্যা খুঁজেছেন। অমিতাভ সরকার, সমীরা দাশগুপ্ত, এন সি সরকার, নিলয় বাগচী, সমীর বিশ্বাস, সি আর মণ্ডল এবং সঙ্ঘমিত্রা পাঁজার এই গ্রন্থ দ্য ফিউমিং ফরেস্ট/অ্যান অ্যানালিটিক্যাল ক্রিটিক (মিত্তল পাবলিকেশনস, ৪৭৫.০০) আলো ফেলেছে আক্ষরিক অর্থেই তৃণমূল স্তরে। কোন সম্প্রদায়ের হাতে কত জমি, সেই সম্প্রদায়ের কত জন ভূমিহীন, বয়সের সীমা সমেত নানা দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে এ গ্রন্থে। প্রত্যন্ত এই সব অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা পরিসংখ্যানও দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

ফিরে আসা যাক সত্তরের দশকে। প্রদীপ বসু সম্পাদিত মননে সৃজনে নকশালবাড়ি গ্রন্থটি (সেতু, ২৭৫.০০) নজর দিয়েছে বাঙালি মননে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাবের উপরে। কিন্তু সূচিপত্রে নিবন্ধগুলির পাশে লেখকদের নাম কেন দেওয়া হল না, বোঝা মুশকিল। ঝোড়ো দশক এখন অতীত। তার ছাই উড়িয়ে হারানো রতন খোঁজার তাগিদ এখনও কেউ কেউ অনুভব করেন। অনুভব করেন প্রান্তিক মানুষের বাঁচা-মরার লড়াই, সুখ-দুঃখের আখ্যান শোনানোর সামাজিক দায় তাঁদের আছে।

শোনারও কি দায় নেই আমাদের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

naxal movement book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE