Advertisement
E-Paper

সেই টানাপড়েন বোঝার জন্য জরুরি

রাবীন্দ্রিক’ ও ‘রাবীন্দ্রিকতা’ শব্দে সচরাচর বিশেষ শীলিত সাংস্কৃতিক পরিসরের কথা মনে আসে বলেই বাঙালি হাটে-বাজারে ‘রবীন্দ্রনাথ হোসিয়ারি’-র বোর্ড দেখলে সচকিত কৌতুকে শিউরে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথ যেন উচ্চসংস্কৃতির উত্‌পাদক। তাঁর সৃষ্টি যেন কেবল ভদ্রলোকক্রীত, এলিটসেবিত।

বিশ্বজিত্‌ রায়

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১

রাবীন্দ্রিক’ ও ‘রাবীন্দ্রিকতা’ শব্দে সচরাচর বিশেষ শীলিত সাংস্কৃতিক পরিসরের কথা মনে আসে বলেই বাঙালি হাটে-বাজারে ‘রবীন্দ্রনাথ হোসিয়ারি’-র বোর্ড দেখলে সচকিত কৌতুকে শিউরে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথ যেন উচ্চসংস্কৃতির উত্‌পাদক। তাঁর সৃষ্টি যেন কেবল ভদ্রলোকক্রীত, এলিটসেবিত। ‘রাবীন্দ্রিক সংস্কৃতি’ ও ‘গণসংস্কৃতি’-র ইতিহাস কিন্তু এমন দূরত্বের নয়, তা টানাপড়েনের। বটতলা অঞ্চলে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের কুড়ি ছঁুই-ছঁুই বয়সে উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’ প্রকাশনা সংস্থার আত্মপ্রকাশ। বাঙালি হিন্দুর জন্য শাস্ত্রগ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ যেমন প্রকাশ করতেন এঁরা তেমনই সুলভে সাহিত্য প্রকাশের দায়িত্বও নিয়েছিলেন। কম পয়সায় মূল ধারার বাংলা সাহিত্যকে ধম্ম-কম্ম করা গেরস্ত আমবাঙালির কাছে হাজির করাই কাজ। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাসের পদাবলি থেকে বঙ্কিমী নভেল, বসুমতী-র মণ্ডপে কত কিছুই যে ছিল। মূলত জনগণের জন্যই তাঁদের গ্রন্থ উত্‌পাদন। সেই পাঁচমিশেলির মণ্ডপে রবীন্দ্রনাথকে কারও একটু বেমানান লাগতেই পারে। বসুমতী থেকে ১৯২২-’৭০ পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল ‘মাসিক বসুমতী’। এই পত্রিকা ‘ভারতী’, ‘সাধনা’, ‘প্রবাসী’, ‘সবুজপত্র’-এর মতো নয়— অভিজাত পাঠকদের জন্যই তার আত্মপ্রকাশ এমন কথা বলা যাবে না। বসুমতী প্রকাশনা সংস্থা ও পত্রিকার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের মধ্যে ‘রাবীন্দ্রিকতা’ বনাম ‘গণসংস্কৃতি’-র টানাপড়েন জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে নানা ভাবে কাজ করেছে। প্রণতি মুখোপাধ্যায় ও অভীককুমার দে-র সুসম্পাদিত রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ: মাসিক বসুমতী বইটি সেই টানাপড়েনকে অনুসরণ করার জন্য জরুরি নথি।

রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ প্রথম প্রকাশিত হয় বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রগুলির মনের কারখানা ঘরে নেমেছিলেন। সেই তুলনায় ‘নৌকাডুবি’ নিতান্তই যেন নৌকা ডুবে যাওয়ার পর কী কী হল সেই ঘটনার সমবায়। নভেলটি ঘটনাখোর আমপাঠকের ভাল লেগেছিল। বিক্রি হয়েছিল যথেষ্ট। বিপত্তির সূত্রপাতও সেখান থেকেই। ‘তিন বছরের প্রকাশনাস্বত্ব লঙ্ঘন করে একটি সংস্করণ শেষ হবার পরে বিনা অনুমতিতে’ উপেন্দ্রনাথ আবার বইটি ছেপে দেন। প্রকাশকের লোভ ও লেখকের বিরক্তি— কার্যকারণের অনিবার্য পরম্পরায় সম্পর্ক কটু হল। আবার বসুমতী প্রকাশিত গানের সংকলন বীণার ঝংকার-এ অনুমতি ছাড়া কবির পঁয়তাল্লিশটি গান অন্তর্ভুক্ত। এবার আইন আদালত হল। রবীন্দ্রনাথ ক্ষতিপূরণ পেলেন। ১৯২৫-এ রবীন্দ্রগ্রন্থাবলির সুলভ-সংস্করণ প্রকাশের প্রস্তাব বসুমতীর পক্ষ থেকে এসেছিল। তবে তা আর কার্যকর হয়নি।

মাসিক পত্রিকা হিসেবে ‘বসুমতী’র আবির্ভাব ১৯২২-এ। এতে রবীন্দ্রনাথ যে খুব নিয়মিত লিখতেন তা নয়। তবে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু লেখা এতে প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে ‘নটীর পূজা’ উল্লেখযোগ্য। বসুমতীর সঙ্গে যাঁদের সখ্য গভীর ছিল তাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যরুচির অনেক পার্থক্য। ‘রক্ষণশীলতা ও হিন্দুভাবাপন্নতা’ (পৃ. ঊনচল্লিশ) এই দূরত্বের একটা কারণ। চিত্তরঞ্জন দাশের অকাল প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হন, তাঁর ‘শোকবাণী প্রকাশিত হয় মাসিক বসুমতী-তে’। সে অন্য কথা, কিন্তু চিত্তরঞ্জনের ‘নারায়ণ’ পত্রিকার সঙ্গে রবীন্দ্রপ্রশ্রয়পুষ্ট প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ পত্র’-এর সাহিত্যবিতর্ক সে কালে সুপরিচিত। তবে ‘বসুমতী’ রবীন্দ্র-বিষয়ক সংবাদ, প্রসঙ্গ নিয়মিত পরিবেশন করেছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ও তাঁকে নিয়ে লেখা, দু’রকম বইয়ের আলোচনাই চোখে পড়ে।

রবীন্দ্রনাথ ‘গণ’ বলতে যা বুঝতেন বা যে ভাবে ‘গণ’কে স্পর্শ করতে চাইতেন বসুমতীর প্রকাশিত বই ও মাসিক তার থেকে আলাদা বোঝাপড়ায় গণের মনোরঞ্জনে নিবেদিত ছিল। রবীন্দ্রজীবনের বড় লক্ষ্য ছিল সামাজিক মানুষের কাছে যাওয়া। লোকশিক্ষায় পরিকল্পিত গ্রন্থমালা তো স্বদেশীসমাজ নির্মাণের জন্যই প্রকাশিত। এই স্বদেশের বৃহত্‌ অংশ যে গ্রামে বাস করেন রবীন্দ্রনাথ তা জানেন। বসুমতীর দলবল এমন দায়িত্ব নিতে চাননি— স্বদেশীসমাজ নির্মাণের গুরুদায়িত্ব তাঁদের নয়। বাঙালি হিন্দুসমাজের শহুরে ও মফস্সলবাসী চাকুরে গেরস্তদের জন্যই তাঁদের আয়োজন। তাকে খাটো চোখে দেখার দরকার নেই— তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মেজাজের পার্থক্যটুকু বুঝে নেওয়া চাই।

এই বই সেই বোঝাপড়ার জন্য খুবই সহায়ক, প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন দুই সম্পাদক। গোড়ায় ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির ও রবীন্দ্রনাথ’ নামের প্রবেশক নিবন্ধে সতথ্য এই সম্পর্কের ইতিহাস বিবৃত। এর পর ‘রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ: মাসিক বসুমতী’। কালের পর্যায়ক্রমে মাসিক বসুমতীতে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনা, রবীন্দ্রবিষয়ক খবর, সংশ্লিষ্ট গ্রন্থের পর্যালোচনা এখানে মূল পত্রিকা থেকে সংকলিত। রবীন্দ্ররচনার সঙ্গের অলংকরণগুলিও রয়েছে। যেমন চৈত্র ১৩৩৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের পদ্য ‘বসন্ত’। ‘কপোত-কাকলীতে করুণা সঞ্চারে,/ কাননদেবী হোলো বিমনা।’ সঙ্গের ছবিতে বুটিদার ছাপাশাড়ি পরা একটা আনমনা মেয়ে বসে রয়েছে গাছ-গাছালি ভরা পরিচ্ছন্ন বনে। দুটো পায়রা গোছের পাখি উড়ে যাচ্ছে। ছিপছিপে মেয়েটির হাতে দুগাছি করে চুড়ি। এই পরিচিত পাশের বাড়ির বাঙালিনিই কবির বনদেবী কি না বলা মুশকিল তবে বসুমতীর গৃহগত পাঠিকারা যে ছবিটির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারতেন তাতে সন্দেহ নেই। বইটির শেষে রয়েছে বিস্তৃত তথ্যপঞ্জি। এখানে খুবই যত্ন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

রবীন্দ্রউত্‌সাহী গবেষক ও রবীন্দ্রবিলাসী পাঠক, সকলেই এই বই কাছে রাখতে চাইবেন।

biswajit roy book review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy