চৌরঙ্গির মোড়ে এসপ্লানেড ডাকঘরের কাছে এখনও গ্রিটিংস কার্ডের পসরা নিয়ে বসেন লিয়াকৎ আলি। তবে, খদ্দের জোটে না। ক্রমেই কমছে গ্রিটিংস কার্ডের ক্রেতা। নেহাৎ নানা মাপের খাম, প্যাড বা সংশ্লিষ্ট কিছু জিনিস থাকে। তাই কোনওক্রমে চলে যায়।
একই অবস্থা জওহরলাল নেহরু রোডের প্রাচীন ও নামী একটি শো রুমের। প্রায় ৬৫ বছর ধরে সেখানে গ্রিটিংস কার্ড বিক্রি করছেন প্রেম প্রকাশ। বললেন, ‘‘আগে ফি বছর বেশ কয়েক হাজার টাকার কার্ড বিক্রি হত। জনহিতকর কাজের কথা মাথায় রেখে বেশি বিক্রি করতাম ‘ক্রাই’ আর হেল্পএজ’-এর কার্ড। আর্চিসের কার্ডেরও ভাল ক্রেতা ছিল। কয়েক বছরে মোট বিক্রির হার প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গিয়েছে।’’ লিয়াকৎ আলির বক্তব্যের রেশটাও অনেকটা এ রকম। ‘‘আগে ডিসেম্বর মাস পড়তেই কার্ড কেনাবেচা শুরু হত। বড়দিনের আগেভাগে বিক্রি বাড়ত অনেকটাই। এখন বিক্রি হয়, তবে অনেক কম!’’
দোকানে গিয়ে শুভেচ্ছা কার্ড কেনা, সুন্দর প্যাকেটে তা ভরে বন্ধুর বাড়িতে পাঠানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন সময় তথ্যপ্রযুক্তির। সব কিছুই হাতের নাগালে। অনলাইনে সার্চ করলে পাওয়া যায় সুন্দর সুন্দর কার্ড। কেবল বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ নয়, বরণ করে নেওয়া যায় বিশেষ দিনগুলোকে। বিশ্বে এগুলোর চাহিদা অনেক। আমাদের দেশেও এর চাহিদা বেড়েছে। প্রেম প্রকাশ জানালেন, ‘‘ই কার্ডও এখন পুরনো হয়ে গিয়েছে। এখন মেল আর হোয়াটসঅ্যাপেই চলছে শুভেচ্ছা বিনিময়।’’
মেনে নিতে পারেন ব্যাপারটা? ‘‘একেবারেই না’’, জানালেন পারিজাত। বললেন, ‘‘আমরা ছেলেবেলায় বড়দিন, বিজয়া, ইংরেজি ও বাংলা নববর্ষে কার্ড বানিয়ে বা এঁকে বিশেষ পরিচিতদের পাঠাতাম। এখন ছেলে ঋভুকে দিয়ে কার্ড বানাই। তবে, ক’দিন বানাবে সন্দেহ!’’
একটা সময় ছিল বছরের শেষ দিক, মানে গ্রিটিংস কার্ড কিনতে দোকানে হুড়োহুড়ি, স্কুলকলেজের ছাত্রছাত্রীদের জমাট ভিড়। দিনের শেষে কার্ড বিক্রির টাকা গুনতে গুনতে ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি। এসএমএস, ফেসবুক, হোয়্যাটসঅ্যাপের গুঁতোয় এ সব এখন ইতিহাস হতে বসেছে।
গত বারেও নতুন বছর শুরুতেই কার্ড উপহার দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে কার্ড দেওয়ার আগে ফেসবুকে নিজের অফিসিয়াল পেজে কার্ডের মাধ্যমে রাজ্য-সহ গোটা দেশকে শুভেচ্ছা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী।
সমাজসেবার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত কিছু সংগঠন বহু বছর ধরেই গ্রিটিংস কার্ড বিক্রি করে উপার্জন করে। তারাও অনেকে সমস্যায় পড়ছে। যদিও হেল্পএজ ইন্ডিয়ার যুগ্ম অধিকর্তা ইন্দ্রাণী সেনের দাবি, ‘‘আমরা এ দিক থেকে খুব সঙ্কটে এখনও পড়িনি। আমাদের কার্ড, ক্যালেন্ডার, প্ল্যানার, ডায়েরির কিন্তু চাহিদা আছে।’’ সর্বত্র কার্ডের চাহিদা কমেছে, আপনাদের কমল না! ইন্দ্রাণীর জবাব, ‘‘আমাদের ক্রেতাদের অধিকাংশ মনে করেন, টাকাটা যথার্থ সমাজসেবায় যাচ্ছে। তাই আমাদের কার্ড বা ক্যালেন্ডারের বাজার এখনও আছে।’’
নবীন প্রজন্ম অবশ্য শুভেচ্ছা জানাতে হোয়াট্সঅ্যাপেই বেশি স্বচ্ছন্দ। ছোট হোক বা বড়, ভালবাসার আসল ভাষা আজও রয়েছে দু’মলাটের মাঝে। এই সরল সত্যটা স্বীকার করেও সাংবাদিকতার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, হাওড়ার অদিতি সাহু বললেন, ‘‘কেবল কার্ড কিনলেই তো হল না, খাম কেনো, তাতে ঠিকানা লেখো, ডাকঘরে গিয়ে ডাকটিকিট কিনে লাগাও, ফের ডাকবাক্সে ফেলো। ব্যস্ততার মধ্যে এত সব করেও প্রাপকের কাছে সময়মতো পৌঁছবে কি না, নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু মোবাইলে বোতামের কয়েকটা চাপেই আমি শুভেচ্ছা জানাতে পারছি প্রিয়জনকে। এই সরল সত্যটাই পিছিয়ে দিচ্ছে কার্ড-সংস্কৃতি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy