Advertisement
০৯ মে ২০২৪
হাসপাতালে পাঠান রোগীকে

প্রশিক্ষণ শিবিরে শেখানো হল ওঝা-গুনিনদের

সাপে কাটলে ওঝা-গুনিনের কাছে নিয়ে যাওয়া এখনও গ্রামবাংলার অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই দস্তুর। ফলে মৃত্যুর সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। চিকিৎসকেরা সব সময়েই বলে আসছেন, সময় মতো রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে বাঁচানো সম্ভব।

সামসুল হুদা
ক্যানিং শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৫২
Share: Save:

সাপে কাটলে ওঝা-গুনিনের কাছে নিয়ে যাওয়া এখনও গ্রামবাংলার অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই দস্তুর। ফলে মৃত্যুর সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। চিকিৎসকেরা সব সময়েই বলে আসছেন, সময় মতো রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু দেখা যায়, ওঝা-গুনিনের কাছে নিয়ে গিয়ে অনেকটা দেরি করে ফেলেন রোগীর আত্মীয়েরা। শেষে যখন উপায়ন্তর না দেখে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন চিকিৎসকদের আর কিছু করার থাকে না।

এই পরিস্থিতির জন্য সচেতনতার অভাব আর কুসংস্কারকেই দায়ী করেন সকলে। সাপে কাটা রোগীকে নিয়ে কী করণীয়, তা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে মানুষকে সচেতন করার কাজটা করে আসছে ক্যানিঙের যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা। এ বার ওঝা-গুনিনদের নিয়ে এক কর্মশালার আয়োজন করল তারা। উদ্দেশ্য, ওঝা-গুনিনদের এটা বোঝানো, সাপে কাটা রোগী এলে তাদের হাসপাতালে পাঠানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া। কোনটা বিষধর সাপের ছোবলের চিহ্ন, কোনটা নয়, সে ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করা। তা ছাড়া, সাপে কাটলে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু যেন করানো যায়, সে ব্যাপারেও যেন ধারণা থাকে ওঝা-গুনিনদের।

ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালের সহযোগিতায় শুক্রবার হাসপাতালের স্নেক বাইট ট্রেনিং হলে ওই শিবিরের উপস্থিত ছিলেন জেলার নানা প্রান্ত থেকে আসা জনা চল্লিশ ওঝা-গুনিন। ছিলেন ক্যানিং ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পরেশরাম দাস, হাসপাতালের সুপার অর্ঘ্য চৌধুরী, মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক ইন্দ্রনীল সরকার, বিশিষ্ট সর্পরোগ বিশেষজ্ঞ সমর রায়, প্রদীপ মিত্র ও যুক্তিবাদী সংস্থার সম্পাদক বিজন ভট্টাচার্য।

সম্প্রতি সন্দেশখালির জেলিয়াখালিতে একই পরিবারের বাবা, মা ও ছেলেকে রাতে ঘুমের মধ্যে সাপে ছোবল মেরেছিল। তাঁদের প্রথমে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে যাওয়া হয় এক ওঝার কাছে। প্রায় ৬ ঘণ্টা পরে ক্যানিং হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। মারা যান চন্দ্রাণী ঘোষ নামে ওই মহিলা। তবে প্রাণে বেঁচে যান তাঁর স্বামী মহাদেব ঘোষ ও ছেলে সৈকত।

কয়েক দিন আগে জীবনতলার দক্ষিণ হোমরা গ্রামের বাসিন্দা কমলা হালদারকে ঘুমের মধ্যে সাপে কামড়ায়। তাঁর পরিবার প্রথমে বাড়িতে নিম পাতা বেটে খাইয়েছিলেন। তাতে কাজ না হওয়ায় স্থানীয় এক হাতুড়ে চিকিৎসককে দেখানো হয়। ওই মহিলাকেও বাঁচানো যায়নি।

মহকুমা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত এক মাসে প্রায় ১১ জনকে সাপে কামড়েছে। তারমধ্যে মারা গিয়েছেন দু’জন। যদিও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সব তথ্য যে স্বাস্থ্য দফতরের কান পর্যন্ত আসে, তা নয়। বেসরকারি হিসেবে, গত এক মাসে প্রায় ২২ জনকে সাপে কামড়েছে। মারা গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৭ জন।

বিজনবাবু বলেন, ‘‘এখনও অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের জন্য মানুষ মারা যাচ্ছেন। সাপে কাটার পরে গ্রাম বাংলার বহু মানুষ এখনও ওঝা-গুনিনের কাছেই ছুটছেন। তাঁরা জানেনই না, ওঝা-গুনিনের এ ক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। হাসপাতালেই প্রকৃত চিকিৎসা সম্ভব।’’

উদ্যোক্তাদের আরও বক্তব্য, সাপে কাটায় মৃত্যু হলে ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ গুনতে হয় সরকারকে। সচেতনতার জন্য বরাদ্দ বাড়ালে আখেরে কোষাগার থেকে ক্ষতিপূরণের খরচ অন্তত বাঁচবে।

প্রশিক্ষণ নিতে আসা এক গুনিন অশীতিপর আঙুরবালা সর্দার বলেন, ‘‘বাপ-ঠাকুর্দার কাছ থেকে শিখেছিলাম, কী ভাবে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করতে হয়। সে সময়ে আমরা থানকুনি পাতা, বুড়ি থানকুনি পাতার রস, কলমি শাকের শেকড় বাটা ও আদা বেটে রোগীকে খাওয়াতাম। সেই সঙ্গে মন্ত্র পড়তাম। কিন্তু তাতে দেখতাম, অনেক রোগী মারা যেতেন। পরে জানলাম, বিষধর সাপে কামড়ালে আমাদের কিছু করার নেই। হাসপাতালেই ঠিকমতো চিকিৎসা সম্ভব।’’ তিনি জানালেন, সাপে কাটা রোগীর ক্ষত দেখে বোঝার ক্ষমতা ছিল না, কী ধরনের সাপে কামড়িয়েছে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ তাঁদের কাছে উপকারী, মনে করেন আঙুরবালা। তবে বেশ কিছু দিন ধরেই তিনি সাপে কাটা রোগী এলে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন বলে দাবি বৃদ্ধার।

গঙ্গাসাগরের গৌরহরি মণ্ডল, ঘুটিয়ারিশরিফের হালিমা বিবিরা জানালেন, তাঁদের হাতেও অনেক সাপে কাটা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা বুঝতে পারলেন, বিষধর সাপ কামড়ালে আমাদের তাঁদের করণীয় কিছুই নেই। এ বার থেকে কোনও সাপে কাটা রোগী এলে তাঁর ক্ষত দেখে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেবেন তাঁরা, জানালেন সে কথাও।

সাপের কামড় খেয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছেন সৈকত ঘোষ। প্রশিক্ষণ শিবিরে এসেছিলেন তিনিও। সৈকতের কথায়, ‘‘সে দিন আমাদের হাসপাতালে আসতে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল। এখন বুঝতে পারছি, যদি প্রথমেই হাসপাতালে আসতাম, তা হলে আজ হয় তো আমার মাকে এ ভাবে চলে যেতে হতো না।’’ শ্রোতাদের কাছে তিনি অনুরোধ করেন, ‘‘এ বার থেকে কাউকে সাপ কামড়ালে আর দেরি করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। দেখবেন, আমার মতো আর কাউকে তার মাকে হারাতে হবে না।’’

সুপার অর্ঘ্যবাবুর মতে, ‘‘এটা সত্যি খুব ভাল উদ্যোগ। ওঝা-গুনিনদের এই জাতীয় প্রশিক্ষণের ফলে তাঁরা বুঝতে পারবেন, বিষধর সাপের কামড়ে তাঁদের বিশেষ কিছু করার থাকে না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ওঝা-গুনিনেরা এ বার ঠিকঠাক পরামর্শ দিয়ে অনেকের প্রাণ বাঁচাতে পারবেন।’’

কিন্তু এ ভাবে রোগীকে হাসপাতালে পাঠিয়ে ‘কেস’ হাতছাড়া হওয়ার ব্যাপারটা কী ভাবে মেনে নিচ্ছেন ওঝা-গুনিনেরা?

এক প্রবীণ গুনিন বললেন, ‘‘এটা আমাদের পেশা ঠিকই। কিন্তু এখন সব জেনেবুঝে কাউকে তো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারি না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Awareness campaign Snake Bite Superstition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE