আয়লার পরে এই পরিস্থিতি হয়েছিল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায়।
সেটাও ছিল এমনই এক মে মাস। চোখ বন্ধ করলে এখনও সেই প্রকৃতির তাণ্ডবের ছবি ভেসে ওঠে সন্দেশখালি ১ ব্লকের মণিপুরের বাসিন্দা স্বপন মণ্ডলের মনে। ২০০৯ সালের আয়লা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল সুন্দরবনকে। বাড়িটা মাটিতে মিশেছিল। জমি-জিরেত যা ছিল, নোনা জল ঢুকে অনাবাদি হয়ে পড়ে। জান বাঁচাতে, পেটের টানে তামিলনাড়ু গিয়েছিলেন স্বপন। লকডাউনের ফেরে আটকে ছিলেন সেখানেই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাড়ি ফিরেছেন দিন তিনেক আগে। অদ্ভুত সমাপতন! মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে স্বপন বলেন, “যে ঝড় বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছিল, বাড়ি ফিরে আবার সেই ঝড়ের সামনেই পড়তে হল!”
এক ঝড়ের ধাক্কায় গ্রামের পর গ্রাম ফাঁকা করে কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। নাম লিখিয়েছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকের দলে। সম্প্রতি করোনা-পরিস্থিতি তাঁদের অনেককেই সেই পাট চুকিয়ে এলাকায় ফিরতে বাধ্য করেছে। এর মধ্যেই চোখে রাঙাচ্ছে আরও এক ঝড়। ভিন্ রাজ্য থেকে ফেরা বহু মানুষই এ বার এলাকায় থেকে রুটি রুজি জোগাড় করার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন। কিন্তু আমপানের পরে সেই সুযোগ থাকবে কী, এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সুন্দরবনের নদী-খাঁড়িতে।
২০০৯ সালের ২৫ মে। ঘূর্ণিঝড় আয়লা আছড়ে পড়েছিল সুন্দরবনের বুকে। কার্যত ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল বাদাবনের জনজীবনকে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল গোটা সুন্দরবন জুড়ে। বাঁধ ভেঙে নদীর নোনা জল ঢুকে প্লাবিত হয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। জলের তোড়ে মানুষ, গবাদি পশু ভেসে গিয়েছিল। হাজার হাজার ঘরবাড়ি এক পলকে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। নষ্ট হয়েছিল কয়েক হাজার হেক্টর চাষের জমি, পুকুর। ঝড়ের পর বেশ কয়েক দিন ধরে এলাকায় ভেসে বেরিয়েছিল গবাদি পশু, মানুষের মৃতদেহের পচা গন্ধ।
ঝড়ের ধাক্কা সামলে থিতু হতেই লেগে গিয়েছিল মাসখানেকের বেশি সময়। কিন্তু তারপরেই মাথাচাড়া দেয় আসল সমস্যা। এলাকার মানুষের অন্যতম জীবিকা ছিল চাষবাস। কিন্ত ঝড়ে নোনা জল ঢুকে নষ্ট হয়ে যায় চাষের জমি। রোজগার হারান একটা বড় অংশের মানুষ। কাজের খোঁজে এদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে পাড়ি দেন ভিন্ রাজ্যে। কেরল, মহারাষ্ট্র, আন্দামানে দিনমজুরি করতে চলে যান। গ্রামে কোনও রকমে চাষবাস করে দিন কাটানো মানুষগুলো সেখানে গিয়ে দু’টো পয়সার মুখে দেখেন। তাঁদের দেখে গ্রামের আরও মানুষ ধীরে ধীরে এলাকা ছাড়েন। এ ভাবেই উপকূলবর্তী এলাকার কয়েক হাজার মানুষ ভিন্ রাজ্যে পাড়ি জমান। সম্প্রতি করোনা-পরিস্থিতিতে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেই এলাকায় ফিরেছেন। অনেকে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।
এর মধ্যেই চোখ রাঙাচ্ছে আমপান। আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, বুধবার দুপুরের পরে আমপান আছড়ে পড়বে স্থলভাগের উপরে। সুন্দরবনের উপরেও তার যথেষ্ট প্রভাব পড়বে বলেই জানানো হয়েছে আবহাওয়া দফতর সূত্রে। দশ বছর আগে আয়লা বা কয়েক মাস আগের বুলবুলের ক্ষত এখনও দগদগে এলাকার মানুষের মনে। আমপান-আতঙ্কে তাই ঘুম ছুটেছে সুন্দরবনবাসীর। আয়লার ভয়াবহতা ফিরে এলে কী হবে, তা ভেবে দিশাহারা বাইরে থেকে ফেরা শ্রমিকেরাও।
সুন্দরবনের বালি দ্বীপে সাধারণ মানুষকে নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান প্রসেনজিৎ মণ্ডল বলেন, “আয়লার পরে এলাকায় কাজ ছিল না। বহু মানুষ বাইরে
চলে যান। করোনার জেরে তাঁদের অনেকে ফিরেছেন। অনেকে ফেরার চেষ্টা করছেন। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে আবার কবে কাজে যেতে পারবেন, কেউ জানেন না। ফলে এলাকাতেই যে যার মতো করে কিছু করার কথা ভাবছিলেন অনেকে। কিন্তু আমপানের পরে আর সেই পরিস্থিতি থাকবে বলে মনে হয় না। জানি না এত মানুষের কী হবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy