জামতলা গ্রামে তখন বসেছে মাদকের আসর। ছবি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক।
কী ভাবে হেরোইনের কারবার ছড়াল জামতলায়? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকটা বছর আগে। গ্রামের প্রবীণ মানুষেরা স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, ১৯৯১-৯২ সাল নাগাদ বাইরে থেকে হেরোইনের নেশায় আসক্ত এক যুবক গ্রামের বাড়িতে ফেরে। হেরোইনের কারবার শুরু তার হাতেই। নিজের বন্ধুবান্ধবদের নেশা ধরিয়ে ছেড়েছিল সে। তবে তার আর খোঁজ জানেন না কেউ।
পরবর্তী সময়ে মাদক কারবারিদের ‘মুক্তাঞ্চল’ হয়ে ওঠে বনগাঁর ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েতের জামতলা ও আশপাশের কিছু এলাকা। একে তো বাংলাদেশ সীমান্ত-লাগোয়া প্রত্যন্ত গ্রাম। স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশ-প্রশাসনের নজর থেকে অনেকটাই দূরে। এখান থেকে চোরাপথে মাদক বাংলাদেশে পাচারেরও সুবিধা আছে। সব মিলিয়ে ক্রমে ক্রমে জামতলা ও সংলগ্ন এলাকাগুলিতে হেরোইন কারবারিরা জাঁকিয়ে বসে। এলাকার কিছু যুবককে এই কাজে লাগানো হলেও মূল কারবারিরা চিরকালই ধরাছোঁয়ার বাইরে, জানাচ্ছেন স্থানীয় মানুষ।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রথম প্রথম বহুমূল্যের এই মাদক এলাকার ছেলেদের হাতে বিনা খরচেই তুলে দেওয়া হতো। দিনের পর দিন সেই হেরোইন খেয়ে নেশা যখন জাঁকিয়ে বসত, তখনই তাদের নিজেদের ব্যবসার কাজে ব্যবহার করত মাদক কারবারিরা। নেশাসক্ত যুবকদের বলা হত, ২৫-৩০টি হেরোইনের পুরিয়া বিক্রি করে দিতে পারলে তবেই বিনা পয়সায় মিলবে নিজের ব্যবহারের হেরোইন। সেই লোভে পা দিয়ে মাদকের কারবারে জড়িয়ে পড়ত তরুণেরা। এখনও একই কায়দায় ব্যবসা চলে, জানালেন গ্রামের অনেকে। কবে কখন কী ভাবে বেআইনি কারবারে জড়িয়ে পড়ে গ্রামের ছেলেরা, তা তারা নিজেরাও জানতে পারে না। কবে নেশা পেয়ে বসে তাদের, সে খবরই বা কে রাখে! সন্তানহারা এক বাবার আফসোস, ‘‘প্রথমে বুঝতেই পারিনি ছেলে হেরোইনের নেশা করে। তারপরে যখন জানতে পারলাম, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’’ ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি।
কিন্তু কারা এই কারবারে যুক্ত, কারা নেশা করে, সে সব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজেদের নাম জানাতে আতঙ্কে ভোগেন স্থানীয় মানুষ। চুপিসাড়ে জানান, যারা মাদকের কারবার করে, তাদের হাত অনেক দূর পর্যন্ত লম্বা। মুখ ফসকে দু’কথা বেরিয়ে গেলে যদি পরিচয়টুকু গোপন না থাকে, তা হলে হয় তো প্রাণেই মেরে ফেলা হবে!
মাঝে মধ্যে ধরপাকড় যে চলে না তা নয়। কিন্তু দু’চার দিনের মধ্যে ফেল কারবার শুরু হয়ে যায়। পুলিশের দাপট একটু বেশি দেখলে কারবার কিছু দিনের জন্য ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলিতে। বনগাঁ শহরও যার বাইরে নয়। সেখানেও চলে হেরোইনের রমরমা কারবার। সদ্য পুরপ্রধান হওয়া শঙ্কর আঢ্য বলেন, ‘‘পুলিশ আরও কঠোর পদক্ষেপ না করলে স্থায়ী সমাধান হওয়া মুশকিল।’’’ পুরসভাকে সঙ্গে নিয়ে মাদকবিরোধী প্রচার চালানো হবে বলে জানিয়েছেন বনগাঁর এস়ডিপিও বিশ্বজিৎ মাহাতো।
জামতলা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে জয়পুরে মহিলারা হেরোইন কারবারিদের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছিলেন কয়েক বছর আগে। ওই এলাকায় এখন এই ব্যবসা অনেকটাই কমে এসেছে। ফের শুরু করেছিল এক ব্যক্তি। প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ান তহিরুন খাতুন-সহ কয়েক জন মহিলা। মাদক কারবারি পরিবারের লোকজন তাঁকে ও আর এক মহিলাকে মারধর করে।
তবু হেরোইনের বিরুদ্ধে এককাট্টা জয়পুরে। তহিরুন বলেন, ‘‘আমরা হেরোইনের বিরুদ্ধে মেয়েদের নিয়ে বাহিনী গড়ে লড়াই চালাচ্ছি। পুলিশ-প্রশাসনকে পাশে পেয়েছি। তবে নিজেরা উদ্যোগী না হলে সমস্যা থেকে পুরোপুরি রেহাই মিলবে না।’’
এলাকার কিছু মাদকাসক্তকে নিয়েই সেই চেষ্টা এক বার চালানো হয়েছিল। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা। ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েতের তৎকালীন প্রধান তৃণমূলের সন্তোষ দাস জানালেন, আন্দোলন শুরু হয়েছিল বটে। কিন্তু বেশি দিন টেঁকেনি। বর্তমান প্রধান তৃণমূলেরই জয়ন্ত বিশ্বাস জানালেন, এলাকার মহিলারা কয়েক বছর আগে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন হেরোইন কারবারের বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের কাছ থেকে সে ভাবে নিয়মিত সাহায্য না পেয়ে এক সময়ে তাঁদের উৎসাহে ভাটা পড়ে। প্রধান বলেন, ‘‘আমি ব্যবস্থা নিতেই পারি। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনকে পাশে থাকতে হবে।’’
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ওই গ্রামে (জামতলায়) হেরোইন বিক্রি বন্ধ করতে লাগাতার অভিযান চালাতে। কোনও অবস্থাতেই হেরোইন বিক্রি করতে দেওয়া হবে না।’’
ইদানীং জামতলায় হেরোইনের কারবার কিছুটা হলেও কমেছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। তবে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হল কিনা, তা জানতে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy