E-Paper

কেন যে বেঁচে গেলাম, আক্ষেপ শয্যাশায়ী রবিনের

বাঁ পায়ে সামান্য শক্তি সঞ্চয় করলেও ডান পা একেবারে অকেজো রবিনের। বার বার সংক্রমণ হচ্ছে সেই পায়ে। ভাঙা শিরদাঁড়া নিয়ে এখনও চলাফেরা করতে পারেন না।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৫১
বিছানায় এ ভাবেই দিন কাটছে রবিনের।

বিছানায় এ ভাবেই দিন কাটছে রবিনের। নিজস্ব চিত্র।

বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া মুড়ি-পেঁয়াজ সঙ্গীদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়ে সবে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রবিন। ঘড়িতে সন্ধ্যা ৬টা ৪০। আচমকা একটা বিকট শব্দ আর অন্ধকার। সেই সঙ্গেই অন্ধকার নেমে এল বাসন্তীর ছড়ানেখালির বাসিন্দা রবিন নাইয়ার জীবনে।

গত বছর বালেশ্বরে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার সময় ট্রেনের সাধারণ কামরায় ছিলেন রবিন। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারান। যখন জ্ঞান ফেরে তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের সরকারি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি। হাত, পা, শিরদাঁড়া কিছুই নাড়াতে পারছিলেন না। ঘটনার পরে কেটেছে প্রায় ন’মাস। এখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন না রবিন। বাড়িতে শুয়ে তাঁর আক্ষেপ, ‘‘এ ভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলে ভাল হত। এই যন্ত্রণা, কষ্ট ভোগ করতে হত না।’’ ভোট নিয়ে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই পরিবারে। রবিন বলেন, ‘‘ভোট দিয়ে কী আমার এই সমস্যা মিটবে!’’

বাঁ পায়ে সামান্য শক্তি সঞ্চয় করলেও ডান পা একেবারে অকেজো রবিনের। বার বার সংক্রমণ হচ্ছে সেই পায়ে। ভাঙা শিরদাঁড়া নিয়ে এখনও চলাফেরা করতে পারেন না। ক্র্যাচে ভর দিয়ে কোনও মতে শৌচকর্মটুকু সারেন। একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নন। আদৌ কোনও দিন নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন কি না, তা জানা নেই রবিনের।

বছর ছত্রিশের যুবকের সারা দিন-রাত কাটে গ্রামের বাড়িতে এক কামরার মাটির ঘরে শুয়ে। ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে পড়ে থেকে থেকে ভুগছেন মানসিক অবসাদেও। ধরা গলায় বললেন, ‘‘আমি মরে গেলে চিকিৎসার বিপুল খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হত না পরিবারের বাকিদের!”

দুর্ঘটনায় বাবা কর্মক্ষমতা হারানোয় পড়া ছাড়তে হয় রবিনের বড় ছেলে রঞ্জনকে। কাঠের আসবাব তৈরির কাজে যোগ দেয় সে। সেখান থেকে সামান্য যা কিছু উপার্জন হয়, তা দিয়েই কোনও মতে সংসার চলে। আত্মীয়-পরিজনের সাহায্যে চিকিৎসা, ওষুধ চলছে কোনও মতে। একের পর এক অস্ত্রোপচারে কার্যত নিঃস্ব পরিবার। রবিনের স্ত্রী টুম্পা বলেন, ‘‘সব ছারখার হয়ে গেল। গ্রামে চাষের কাজ পেলে একটু আধটু করি। কিন্তু এখানে টানা কাজ মেলে না। এই রোজগার দিয়ে সংসার চলে না। চিকিৎসা, অপারেশন সব কিছুর জন্যই লোকের কাছে হাত পাততে হয়।’’

রবিন জানালেন, রাজ্যের তরফে দুর্ঘটনার পরে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা মিলেছিল। কিন্তু রেলের তরফে ক্ষতিপূরণের টাকা আজও পাননি। রেলের আদালতের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। আদালত ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দেওয়ার নির্দেশ দিলেও রেলের তরফে এখনও তা পালন করা হয়নি বলে অভিযোগ রবিনের। দক্ষিণ পূর্ব রেলের জনসংযোগ আধিকারিক আদিত্যকুমার চৌধুরী বলেন, ‘‘দুর্ঘটনায় সকলেই ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। রবিন কেন পাননি, তা খতিয়ে দেখতে হবে। খড়্গপুর ডিভিশিনের ডিআরএমের সঙ্গে উনি যোগাযোগ করতে পারেন। আশা করি, সমাধান হয়ে যাবে।’’

সংসারে স্বচ্ছলতা আনার আশাতেই অন্ধ্রপ্রদেশেে কাজ নিয়েছিলেন রবিন। করমণ্ডল এক্সপ্রেসে দশ সঙ্গীর সঙ্গে রওনা হন। দুর্ঘটনায় রবিনের তিন আত্মীয় দিবাকর গায়েন, হারান গায়েন, নিশিকান্ত গায়েন সহ গ্রামের ছ’জনের মৃত্যু হয়েছিল। প্রাণে বাঁচলেও এই জীবনকে বাঁচা বলে কী, প্রশ্ন করেন রবিন। বলেন, ‘‘আমি মারা গিয়েছি ভেবে লাশের ঢিবির উপরে ফেলে দিয়েছিল। সাংবাদিকেরা ছবি তোলার সময়ে হাত নড়তে দেখে উদ্ধার করেন। কিন্তু কেন যে বাঁচলাম!’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Train accident

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy