চেষ্টা: একা হাতেই ছেলেমেয়েদের ক্লাস করাচ্ছেন দেবলীনা। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়
ক্লাস চলছে পঞ্চম শ্রেণির। একটু তফাতে বসে উসখুস করছে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা। খানিকক্ষণ পরে সে দিকে তাকিয়ে দিদিমণি বললেন, ‘‘হ্যাঁ, তোমাদের যেটা বলছিলাম...।’’
একই ঘরে বসে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা। সংখ্যাটা কমতে কমতে ছত্রিশে এসে ঠেকেছে। তাঁদের পড়ানোর জন্য আছেন এক জন মাত্র শিক্ষিকা। যিনি কখনও অষ্টম কখনও ষষ্ঠ শ্রেণির বই হাতে পড়াতে থাকেন। সে সময়ে অন্য শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা অপেক্ষায় বসে থাকে, কখন তাদের দিকে তাকাবেন দিদিমণি। উঁচু ক্লাসের পড়া শুনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে ছোটরা।
এমনই হাল দেগঙ্গার সরকার-পোষিত গাংধূলাট গাংনিয়া জুনিয়র হাইস্কুলে। দীর্ঘ দিন ধরে চলছে এই পরিস্থিতি। অভিভাবকেরা জানালেন, সরকারি স্তরে শিক্ষক নিয়োগের আবেদন করা হয়েছে অনেক বার। লাভ কিছুই হয়নি।
২০১১ সালে দু’জন অবসরপ্রাপ্ত ‘অতিথি শিক্ষক’ দিয়ে জুনিয়র স্কুলটি চালু হয়। স্থানীয় মানুষজন জানালেন, কাছাকাছি এলাকায় জুনিয়র হাইস্কুল না থাকায় চাঁপাতলা পঞ্চায়েতের বেশ কয়েকটি প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এই স্কুলে ভর্তি হতে থাকে। ২০১৩ সালে স্কুলে যোগ দেন দেবলীনা ভৌমিক নামে এক শিক্ষিকা। তারপর থেকে আর কোনও শিক্ষক যোগ দেননি। অতিথি শিক্ষকেরাও চলে গিয়েছেন। এখন গোটা স্কুলটি একা সামলাচ্ছেন দেবলীনা।
স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, একটি ঘরেই ভাগ ভাগ করে বসে বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা। সপ্তম শ্রেণির পড়া শেষ হতেই, অন্য শ্রেণির ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে উঠল, ‘দিদিমণি, এ বার আমাদের পড়ান।’
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী পূজা মণ্ডল বলে, ‘‘দিদিমণি একা সব ক’টা বই পড়ানোর সময় পান না। আমরা বাড়িতে কিছুটা পড়ে নিই।’’ ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা মিজাইল মোল্লা বলেন, ‘‘অন্য স্কুলটি বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে। সেখানে যাতায়াতে খরচ অনেক। সে জন্যই এখানে স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু যা পরিস্থিতি, কী করব বুঝতে পারছি না!’’
অনেকেই ইতিমধ্যে স্কুল ছেড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা মসিউর মোল্লা বলেন, ‘‘ক’বছর আগেও স্কুলে ১৪০ জন ছাত্রছাত্রী ছিল। পড়াশোনা না হলে পড়ুয়ারা গিয়ে কী করবে?’’ মঞ্জুরা বিবির প্রশ্ন, ‘‘কষ্ট করেই তো বাবা-মায়েরা সন্তানদের পড়ায়। ছেলেমেয়েরাও এখন পড়াশোনায় ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী। এক জন শিক্ষিকা দিয়ে সব ক্লাস পড়ানো যায়?’’
একমাত্র শিক্ষিকা তিনি, স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বও তাঁর। দেবলীনা বলেন, ‘‘কোমরের সমস্যার জন্য বেল্ট বেঁধে চলাফেরা করি। তবু ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে প্রতিদিন আসি। কিন্তু একা সব ক্লাসে পড়ানো কি সম্ভব?’’ তিনি জানান, স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে বিদ্যালয় পরিদর্শক থেকে স্থানীয় নেতৃত্ব— সর্বত্রই জানানো হয়েছে। তবে সমস্যার সমাধান হয়নি।
দেগঙ্গার বিদ্যালয় পরিদর্শক সাহানাজ আলম অবশ্য বলেন, ‘‘সরকারি তরফে নিয়োগ বন্ধ থাকায় ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষক দেওয়া যায়নি। তা ছাড়া, স্বল্প বেতনে অতিথি শিক্ষকেরাও পড়াতে রাজি হচ্ছেন না। তাই এই সমস্যা।’’
কিছু দিন সাগরের স্কুলে একমাত্র পুরো সময়ের শিক্ষিকাকে ‘রিলিজ’ দিতে রাজি ছিলেন না পরিচালন সমিতির সভাপতি। পড়াশোনা তো বটেই, স্কুলের প্রশাসনিক কাজকর্মও লাটে উঠবে বলে ওই শিক্ষিকার বদলি নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল সভাপতির। বিষয়টি আদালতে গড়ায়। শেষমেশ সংবাদপত্রে খবর প্রকাশের পরে হস্তক্ষেপ করেন শিক্ষামন্ত্রী। পুরো সময়ের দুই শিক্ষিকা পেয়েছে ওই স্কুল। দেগঙ্গার স্কুলের কী ভবিতব্য, তা অবশ্য সময়ই বলবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy