Advertisement
১১ মে ২০২৪

দালাল থেকে বাঁচুন, বলছে হাসপাতালই

কয়েকদিন ধরেই স্বামীর বমি-পেটে যন্ত্রণা। তার উপর কোলে ছোট ছেলে। ওই অবস্থাতেও হাসপাতালে এসেছিলেন মঙ্গলকোটের গিধগ্রামের হালিমা বিবি।

এই নোটিসই ঝুলছে আউটডোর, ওটির কাছে। নিজস্ব চিত্র।

এই নোটিসই ঝুলছে আউটডোর, ওটির কাছে। নিজস্ব চিত্র।

সুচন্দ্রা দে
কাটোয়া শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৬ ০১:৪৪
Share: Save:

কয়েকদিন ধরেই স্বামীর বমি-পেটে যন্ত্রণা। তার উপর কোলে ছোট ছেলে। ওই অবস্থাতেও হাসপাতালে এসেছিলেন মঙ্গলকোটের গিধগ্রামের হালিমা বিবি। কিন্তু এক দিকে ভ্যানে শোয়ানো স্বামীর দেখভাল, আর এক দিকে আউটডোরে লাইনে দাঁড়ানো, দু’দিক সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন বছর কুড়ির ওই বধূ।

হঠাৎ ভেসে উঠলেন এক অজ্ঞাতপরিচয় ‘দাদা’। হালিমা বিবির কথায়, ‘‘হঠাৎ করে আমার কাছে এলেন উনি। তারপরে বললেন, ‘তোমার স্বামীকে লাইন টপকে আগে ডাক্তার দেখিয়ে দেব। কিন্তু ৫০ টাকা লাগবে’। আমিও আর কিছু না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। ডাক্তার দেখানো সত্যিসত্যিই লাইনের বেশ খানিকটা আগে হয়ে গেল।’’

হালিমা বিবির কাছে ৫০ টাকায় ব্যাপারটা মিটে গেলেও কাটোয়া হাসপাতালে এই দালাল চক্রে পড়ে অনেককেই হাজার, দু’হাজার টাকা দিতে হয়। হাসপাতালের হেমরাজ ব্লাডব্যাঙ্কেও রক্ত পেয়ে গেলে কারও না কারও ‘হাত’ ধরতে হয় বলে অভিযোগ। এত দিন টনক না নড়লেও এ বার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নড়ে বসেছে। সোমবার দেখা যায়, দালালদের হাত থেকে রোগীদের বাঁচাতে এবং সাবধান করতে হাসপাতালের নানা জায়গায় পোস্টার সাঁঠানো হয়েছে। ইমারজেন্সি বিভাগ থেকে আউটজোর, ওটি সর্বত্রই দেওয়ালে ঝুলছে রোগীদের প্রতি সর্তকবার্তা। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘দালালদের খপ্পরে পড়লে তৎক্ষণাৎ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন’।

কাটোয়া হাসপাতাল ঘিরে দালালদের রমরমার অভিযোগ অবশ্য বহু পুরনো। আশপাশের বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ থেকে আসা রোগীরাও নিত্য দিনই দালালদের হাতে পড়ে বেশি টাকা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিদিনই প্রায় ৪০০ মানুষ আউটডোরে চিকিৎসা করাতে আসেন। তাঁদের বেশির ভাগই গ্রামের। অভিযোগ, রোগীর পরিজনেদের অবস্থা আন্দাজ করে টাকা দাবি করে এই দালালেরা। কারও কাছে তাঁদের ‘পারিশ্রমিক’ ১৪০০ টাকা, কারও কাছে ‘আব্দার ’তিন হাজার। হাসপাতালে ভর্তি এক থ্যালাসেমিয়া রোগীর আত্মীয়ের কথায়, ‘‘এত দিন হাসপাতালে রক্তসঙ্কট চলছিল। আমার ছেলের ‘ও নেগেটিভ’ রক্ত লাগে। ছেলেটাকে বাঁচাতে নিরুপায় হয়ে চড়া দামে রক্তদাতা নিতে হল।’’ আবার কখনও হাসপাতালে বেড পাওয়ার জন্যও রোগীর পরিবারকে দালালদের মোটা টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ। হাসপাতালের একাংশ কর্মীদেরও ওই দালালদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। বহু রোগীর পরিবার যেমন জানেনই না যে হাসপাতালে বিনামূল্যে প্যাথোলজি পরীক্ষা করা হয়। কর্মীদের কেউ তাঁদের এ কথা জানানও না। কাটোয়া ন্যাশনাল পাড়ার রূপা বিশ্বাস যেমন জানতেন না যে হাসপাতালে বিনামূল্যে এক্স-রে করানো হয়। দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে বেসরকারি প্যাথোলজি ল্যাবে ৫০০ টাকা খরচা করে শিরদাঁড়ার এক্স-রে করিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ যদি একটু জানাত তাহলে এত গুলো টাকা গচ্চা যেত না।’’ রোগীদের একাংশ জানান, দালালেরা তাঁদের বোঝান ইউএএসজি বা ইসিজি করাতে হাসপাতালে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। বাইরে অনেক সহজে তেনা ল্যাবে পরীক্ষা করিয়ে দেবেন তাঁরা। সময় বাঁচাতে অনেকই সেই ফাঁদের পা দেন। বেসরকারি ল্যাবে বেশি টাকা তো লাগেই, সঙ্গে দালালকে দিতে হয় আরও টাকা। কাটোয়ার সুদপুরের এক রোগীর আত্মীয় জানান, দালাল তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন খারাপ। তাছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার মানও অনুন্নত। ডাক্তারের দেখাও মেলে না। কাজেই বেশি খরচা হলেও বাইরে এক্স-রে করানোই ভাল। তিনিও কথায় ভুলে বাইরে থেকেই এক্স-রে করিয়েছিলেন। এ ছাড়া চিকিৎসকদের হাসপাতালে না দেখিয়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে দেখানোর জন্যও প্রভাবিত করেন দালালেরা।

হাসপাতালে সাঁটানো পোস্টারে কর্মীদের এই চক্র জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, এরকম ঘটনার শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। কাটোয়া হাসপাতালের সুপার রতন শাসমলের বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে না চাইলেও বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রনবকুমার রায় বলেন, ‘‘রোগী দালাল চক্রের শিকার হয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেবে হাসপাতাল। দ্রুত জেলার অন্য মহকুমা হাসপাতালেও এই নির্দেশিকা জারি করা হবে।’’ হাসপাতালের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন কয়েকজন কর্মীও। তাঁদের কথায়, ‘‘প্রতারণা থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নোটিস দেখে আশা করি রোগীরা সতর্ক হবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hospital broker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE