সতর্কবার্তা হাসপাতালে। নিজস্ব চিত্র
চার বোতল রক্তের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছিলেন এক প্রসূতির পরিবারের লোকজন। অপরিচিত এক যুবক তাঁদের আশ্বাস দেয়, সে রক্ত জোগাড় করে দেবে। সে জন্য তাকে দিতে হবে চার হাজার টাকা। টাকা দিয়েও দিয়েছিলেন বীরভূমের ওই প্রসূতির বাড়ির লোকজন। কিন্তু, রক্ত এনে দিতে না পারায় সেই যুবককে চেপে ধরেন তাঁরা। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে ওই যুবককে।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক ধরা পড়লেও সব ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না, দাবি রোগীর পরিজনদের। তাঁদের অভিযোগ, ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে দালালদের দৌরাত্ম্য কার্যত স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে রক্তের জন্য ‘প্রসেসিং চার্জ’ নেওয়া বন্ধ হয়েছে ব্লাড ব্যাঙ্কে। দালাল-দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে কবে, সেটাই এখন প্রশ্ন রোগীদের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যদিও দাবি, দালাল রুখতে তাঁরা কঠোর পদক্ষেপ করেছেন।
ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীদের একাংশের দাবি, সরাসরি রক্ত জোগাড় করার আশ্বাস দিয়ে টাকা নেওয়ার ঘটনা কম ঘটে। তবে ‘প্রসেসিং চার্জ’ নিয়ে শোরগোলের ঘটনার আগে পর্যন্ত রোগীর আত্মীয় সেজে ‘দালালেরা’ ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত দিয়ে যেত। মুখ চেনা হয়ে গেলেও রোগীর আত্মীয় পরিচয়ে রক্তদান করতে আসায় তাদের নিরস্তও করতে পারতেন না তাঁরা, দাবি কর্মীদের। রোগীর পরিজনদের অভিযোগ, দিনের বেলায় আত্মীয় সেজে রক্ত দিলে দালালেরা ১০০০-১২০০ টাকা দাবি করত। সন্ধ্যার পরে টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াত ১৫০০-১৬০০ টাকা। রাত বাড়লে দালালদের চাহিদা আরও বাড়ত।
মেমারির বাসিন্দা সুবিমল রায় জানান, কয়েক মাস আগে তাঁর এক পরিচিতকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, চার ইউনিট রক্ত ছাড়া অস্ত্রোপচার করা যাবে না। তাঁর অভিযোগ, ‘‘হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকার পরেও দু’টি ‘ডোনর কার্ড’ দিয়ে রক্ত নিয়েছিলাম। পরে ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে দু’জন রক্তদাতা আনতে বলা হয়। এক জনকে জোগাড় করেছিলাম। আর এক জনকে ১৬০০ টাকা দিয়ে আত্মীয় সাজাতে হয়েছিল।’’ একই রকম অভিজ্ঞতা কালনার শেখ ইয়াসমিনের। তাঁর কথায়, ‘‘ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে রক্ত মিলবে কি না, চিন্তায় ছিলাম। তখনই এক জন জানায়, ১২০০ টাকা দিলেই রক্ত মিলবে। তার হাতে টাকা দিয়েছিলাম। রক্তও মিলেছিল।’’
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপরে দুই বর্ধমান ছাড়াও হুগলি, বীরভূম জেলা, এমনকি ঝাড়খণ্ডের একাংশ নির্ভরশীল। প্রতিদিন একশোরও বেশি রক্তের প্যাকেটের প্রয়োজন হয়। রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মহম্মদ আসফারউদ্দিনের অভিযোগ, ‘‘প্রয়োজনীয় গ্রুপের রক্ত থাকলেও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্ক দিতে চায় না। ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ যে কোনও গ্রুপের রক্তদাতা নিয়ে এসে বিনিময়ের ব্যবস্থা করতে বলে।’’ তাঁর দাবি, এই কারণেই ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে দালালেরা ঘুরে বেড়ায়।
রক্ত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মানুষজনের আরও দাবি, ‘ডোনর কার্ড’ ছাড়া সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকে রক্ত দেওয়া হত না। ওই কার্ড না থাকলে ‘প্রসেসিং চার্জ’ দিতে হত। সে কারণেও দালালদের উৎপাত ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে দালাল-দৌরাত্ম্য কমা উচিত, মনে করেন অনেকেই।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানান, দালালদের চিহ্নিত করে পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীদের সতর্ক করা হয়েছে। রোগীর পরিজনেরাও যাতে দালালদের খপ্পরে না পড়েন, সে জন্য বার্তা দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল চত্বরে।
সে সবে কাজ কতটা হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy