Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

কাজ থাকলে কি ছেলেকে দূরে পাঠাতাম

খণ্ডঘোষের বেরুগ্রামের কিশোর বজরুল মল্লিকের স্মৃতি এখনও টাটকা এলাকায়। সে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে গিয়েছিল তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ে। গত ১০ জানুয়ারি বিকেলে তার বাড়িতে ফোন আসে, পাঁচ তলার বাড়ির কাজ করার সময় সে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছে।

ছেলে ভিন্ রাজ্যে, রয়েছে তার ‘সবুজসাথী’র সাইকেল। নিজস্ব চিত্র

ছেলে ভিন্ রাজ্যে, রয়েছে তার ‘সবুজসাথী’র সাইকেল। নিজস্ব চিত্র

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৮ ০১:৪৫
Share: Save:

বাড়িতে রয়েছে ‘সবুজ সাথীর’ সাইকেল।

সেই সাইকেলে চেপে স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করার কথা শেখ জাহাঙ্গিরের। কিন্তু, সেই সাইকেল চালাচ্ছেন তার বাবা শেখ বশির। ভাতারের বামশোরের দশম শ্রেণির ছাত্র জাহাঙ্গির পরিবারের স্বার্থে ‘খাটতে’ গিয়েছে ভিন্ রাজ্যে। শুধু ওই পড়ুয়া নয়, পূর্ব বর্ধমানের বিভিন্ন গ্রামের কিশোররা ‘কাজের খোঁজে’ পাড়ি দিচ্ছে কেরল-চেন্নাই-মুম্বই থেকে গুজরাতেও। কেউ করছে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হিসাবে। কেউ কেউ কাজ পাচ্ছে নির্মাণ শ্রমিকের। অনেকে গহনা প্রস্তুতকারক ও এমব্রয়ডারি সংস্থায় কাজ শিখতেও ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছে। এদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ১৮।

খণ্ডঘোষের বেরুগ্রামের কিশোর বজরুল মল্লিকের স্মৃতি এখনও টাটকা এলাকায়। সে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে গিয়েছিল তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ে। গত ১০ জানুয়ারি বিকেলে তার বাড়িতে ফোন আসে, পাঁচ তলার বাড়ির কাজ করার সময় সে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছে। যদিও মৃত কিশোরের পরিবার নির্মাণ সংস্থার দাবি মানতে নারাজ ছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, মাসে ১২ হাজার টাকা বেতনের আশ্বাস দিয়ে কাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বজরুলকে।

কিন্তু, আট মাস ধরে কোনও টাকা সংস্থার তরফে ছেলেটিকে দেওয়া হয়নি, আবার বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রেও ছিল নিষেধাজ্ঞা। অবশেষে ঘটনার চার দিন পরে মাদুরাই থেকে কিশোরের দেহ ফিরল খণ্ডঘোষের বেরুগ্রামে। যে বয়সে তার স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সেই সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে প্রাণ খোয়ালো বজরুল।

ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে গ্রামের নাবালকদের কী দুর্দশা হয়েছিল, তা ভাল টের পেয়েছে আউশগ্রামের ওয়ারিশপুর। ওই গ্রামের কিছু মহিলা জানালেন, তাঁদের পাড়ার ছ’জন ছেলেকে অসমে কাজ দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল এক ‘এজেন্ট’। কিন্তু, নাবালকদের তোলা হয়েছিল জম্মু ও কাশ্মীরের লে শহরের কাছে চিলির-নিমুতে। প্রচণ্ড শীতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেতু তৈরির কাজ করতে হতো। কাজ বলতে পাথর ভাঙা। সাগর শেখ, আকাশ শেখরা বলে, “টানা ২৮ দিন রাস্তার ধারে ভাঙা ঘরে থাকতে হয়েছে। খেতে দেয়নি।” সামিরুল মোল্লার কথায়, “সকালে উঠে কাজ করার সময় ঢুললে লোহার রড দিয়ে হাতে মারত।”

সাগরদের অভিযোগ, ওই জ্বালা থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল ধরা পড়ে কয়েক জন। অত্যাচারও বেড়ে যায়। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ পুরো বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ওই ছয় নাবালকের পরিবার আউশগ্রাম থানায় লিখিত অভিযোগ করে। ওই কিশোরদের এক জনের মা ফুলবানু শেখ বা পড়শি হাসিবা বিবির দাবি, “ওই এজেন্ট ছেলেদের কাশ্মীরে ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। বাড়ি ফেরার সময় পারিশ্রমিক তো দূরের কথা, জামা-প্যান্ট ছাড়া সব কিছুই বিক্রি করে দিয়ে আসতে হয়েছে ছেলেদের।”

বিপদের আশঙ্কা সত্ত্বেও ভিন্‌ রাজ্যে বাড়ির ছেলেদের কেন পাঠাচ্ছেন অভিভাবকেরা?

ভাতারের বামশোর গ্রামে বাদশাহী রোডে ছেলে জাহাঙ্গিরের ‘সবুজ সাথী’ সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে শেখ বশির বললেন, “নবম শ্রেণিতে ওঠার পরেই ছেলে এই সাইকেল পেয়েছে। ওই সাইকেল আমি চালাই। পেটের টানে ছেলে গিয়েছে ভিন রাজ্যে কাজ করতে।”

স্কুলের খাতায় নাম থাকার পরেও পড়ুয়াদের পড়াশোনার জন্য না পাঠিয়ে ভিন রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়ার কারণ মূলত এটাই। পেটের টান। সংসারে আরও কিছু রোজগার এনে দেওয়া। ফলে, ছেলে একটু বড় হলেই তাকে কাজে লাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা জাঁকিয়ে বসেছে অনেক গরিব পরিবারের মধ্যে। এবং সেই প্রবণতাই নাবালক শ্রমিকদের ঠেলে দিচ্ছে বিপদের মুখে। ঠিক যেমন মাদুরাইয়ে গিয়ে হয়েছিল বজরুলের।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sabuj Sathi State Government খণ্ডঘোষ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE