বাঁ দিকে, দুর্ঘটনার পরে গাড়ি থেকে দেহগুলি বের করার কাজ চলছে। ডান দিকে, কান্নায় ভেঙে পড়েছেন বাকি বন্ধুরা। —নিজস্ব চিত্র।
বছর শুরুর পিকনিকে রান্নার তোড়জোড় শুরু হতেই ফাঁকে গাড়ি নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিলেন পাঁচ যুবক। কিন্তু মাঝপথে ট্রাকের মুখোমুখি ধাক্কায় প্রাণ হারালেন পাঁচ জনই।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা নাগাদ বর্ধমান-সিউড়ি রোডে আলমপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ওই দুর্ঘটনাটি ঘটে। বছরের শুরুর দিনেই এমন শোকে নিঃস্তব্ধতা নেমেছে ভাতারের ভূমসোর গ্রামে। ওই গ্রামেরই ছেলে ছিল মৃত সইদুল শেখ, সাগর শেখ, জামাল শেখ, কাজল মণ্ডল ও ইব্রাহিম শেখ। ঘটনার আকস্মিকতা কাটতেই উত্তেজিত আশপাশের বাসিন্দারা ওই রাস্তায় হাম্প তৈরির দাবিতে ঘণ্টাখানেক পথ অবরোধ করেন। পুলিশ অবরোধ তুলতে গেলে পুলিশের সঙ্গে বচসাও বাধে। পরে পুলিশ হাম্প তৈরির প্রতিশ্রুতি দিলে বিক্ষোভ ওঠে। জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “ওই ট্রাকটিকে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ট্রাকের চালকেও।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ভূমসোর থেকে গাড়িতে করে খড়ি নদীর উপরের একটি পিকনিক স্পটে এ দিন চড়ুইভাতি করতে এসেছিলেন ওই আট যুবক। নদীর পাড়ে পৌঁছে রান্নার তোড়জোড় শুরু হতেই তিনজনকে রেখে চার কিলোমিটার দূরের আলমপুরে মৃত সইদুল শেখের এক আত্মীয়ের বাড়িতে দেখা করতে বেরিয়ে পড়েন পাঁচ জন। পথে আলমপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে রাস্তায় আচমকা একটি ছাগল উঠে পড়ায় তাকে বাঁচাতে গিয়ে রাস্তার অন্য দিকে সরে যায় গাড়িটি। মুহুর্তে গাড়িটিকে পিষে দিয়ে যায় উল্টো দিক থেকে দ্রুতগতিতে আসা একটি ট্রাক। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় চার জনের। আর আরেক জন ইব্রাহিম শেখকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানেই মারা যান তিনি।
দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়েও দেখা যায়, গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে ট্রাকের সামনে ঢুকে গিয়েছে। লাঠি, শাবল দিয়ে পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা দেহগুলি বের করার চেষ্টা করছেন। তখনও ধিকি ধিকে ধোঁয়া বের হচ্ছে গাড়ির সামনের অংশ দিয়ে। পরে দমকলের একটি ইঞ্জিন এসে পুরোপুপরি আগুন নেভায়। আলমপুরের বাসিন্দা একমত চৌধুরী, কয়রাপুরের বাসিন্দা আবু ফকির বলেন, “আচমকা মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় দুটি যানের চালকই থতমত হয়ে গিয়েছিলেন। অকালে প্রাণ গেল তাজা ছেলেগুলোর।” ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শেখ হায়দর আলির অভিযোগ, “যে জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে কোনও হাম্প নেই। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই হাম্প তৈরির দাবি করছি। কিন্তু পুলিশ, প্রশাসন কেউই কর্ণপাত করেনি।” হাম্প গড়ার দাবিতে ঘণ্টাখানেক অবরোধও করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশ অবরোধ তুলতে গেলে বচসা বাধে। রাস্তা কেটে দিনভর বিক্ষোভের হুমকিও দেন এলাকাবাসী। পরে বর্ধমান থানার আইসি আব্দুল গফফর অবিলম্বে ওই জায়গায় হাম্প তৈরির প্রতিশ্রুতি দিলে বিক্ষোভ ওঠে। যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়।
তবে স্বাভাবিক হয়ে পারেনি ভূমসোর গ্রাম। বছরের শুরুতেই ১৬ থেকে ২৪ বছরের পাঁচটা ছেলের প্রাণ যাওয়া মেনে নিতে পারেননি গ্রামের মানুষ। দেখা যায়, সইদুল, সাগরদের বাড়ির চারপাশে ভিড় করে রয়েছেন বাকিরা। আলোচনা চলছে দুর্ঘটনা নিয়েই। মৃত কাজল শেখের দাদা হীরালাল শেখ ও ভূমসোরের বাসিন্দা শেখ রহমত বলেন, “ওই আটজনের সকলেই কৃষিজীবি পরিবারের সন্তান। আনন্দ করতে গিয়ে কী যে হল, মেনে নেওয়া যায় না।” সইদুল, সাগরদের আত্মীয় সূরজ শেখ বলেন, “গ্রামে সকাল থেকেই নতুন বছরে আনন্দের পরিবেশ ছিল। অনেকেই নানা জায়গায় পিকনিক করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ঘটনার খবর আসতেই সকলে হতচকিত হয়ে যান। পিকনিক ফেলে অনেকে হাসপাতালে ছোটেন। অনেক বাড়িতেও এ দিন খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।” মৃত সাগরের বাবা বাপি মণ্ডল বলেন, “আমরা চাষবাস করে খাই। শীতে ধান ওঠার পরে সকলেই আনন্দে করতে চায়। তবে ওরা গাড়ি করে যাবে শুনে আমি সাগরকে বলেছিলাম, বাইরে না গিয়ে গ্রামেই পিকনিক করতে। কিন্তু ওরা কথা না শুনে গেল। আর ফিরল না।”
যে বাড়িতে সইদুলেরা যাচ্ছিলেন সেই মইনুদ্দিন শাহর বাড়িতে গিয়েও দেখা গিয়েছে তিনি কথা হারিয়েছেন। হাসপাতালে যাওয়ার আগে কোনওরকমে বলে যান, “ওরা তো আমার বাড়িতে প্রায়ই আসতো। এ দিনও আসছিল। মাঝে যে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি।” বাড়ির মহিলারাও থম মেরে বসে রয়েছেন। মইনুদ্দিন সাহেবের মেয়ে আনজিমা খাতুন বলেন, “সকলেই আমাদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ট। এমন হবে কল্পনা করতে পারিনি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy