পরিত্যক্ত সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক করে গত সোমবার বেলুড়ের বজরংবলী বাজার সংলগ্ন এলাকায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বহু মানুষ। বাজারের যে গুদামে সিলিন্ডার-বিপর্যয় ঘটেছিল, সেটিতে এক সময়ে রাখা হত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতিল জিনিসপত্র! সেই সব জিনিসের হাত ধরে পথ চলা শুরু করে এই বাজার এক সময়ে এশিয়ার বৃহত্তম লোহা বাজারের তকমা পেয়েছিল। সোমবারের সিলিন্ডার-বিপর্যয়ের পরে ফের শিরোনামে হাওড়ার গিরিশ ঘোষ রোডের সেই বজরংবলী লোহা মার্কেট।
সুনাম ছিল না কোনও দিনই। বরং, ছাঁট লোহার ভাগাভাগি ও ‘জিটি’ (গুন্ডা ট্যাক্স বা তোলা) আদায় ঘিরে দিনের আলোয় রিভলভার বার করে হুমকি অথবা কাউকে ‘খালাস’ করে দেওয়ার জেরেই সকলের কাছে পরিচিত ছিল এই বাজার।
কিন্তু যুগ বদলের সঙ্গে বদলেছে বজরংবলী লোহা মার্কেট। অন্য রাজ্যেও লোহার বাজার গড়ে ওঠায় বজরংবলীতে এখন ভাটার টান— তেমনই দাবি ব্যবসায়ীদের। অনেক গুদাম বন্ধ হয়ে সেখানে মাথা তুলছে বহুতল। তবুও প্রায় ২ কিমি বাই ২ কিমি এলাকা জুড়ে ‘টিমটিম’ করে হলেও রয়েছে সর্বদা ধুলো, ময়লা ও খানাখন্দে ভরা বজরংবলী বাজার। শেষ কয়েক বছরে কৌলিন্যে ভাটা পড়েছে।
তার পরেও এই বাজারে প্রতি দিন প্রায় দেড়শো কোটি টাকার লেনদেন!
গঙ্গার পশ্চিম কূল হাওড়ার উত্তর প্রান্তে লিলুয়ায় এই বাজারের বয়স ৭০ বছরেরও বেশি। ‘শ্রী বজরংবলী মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি রামবাহাদুর দুবে জানালেন, ১৯৪৫ সাল নাগাদ কলকাতার জোড়া গির্জা এলাকার বাসিন্দা মৃগাঙ্কমোহন শূরের থেকে জমি ভাড়া নিয়ে গুদাম বানান রামেশ্বর লাল। ওই গুদামে রাখা হত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাতিল মালপত্র। পরিবার ভাগ হওয়ায় এখন ভাগ হয়েছে রামেশ্বরের গুদামও। তাঁরই এক নাতির গুদামে লিক করেছিল গ্যাস।
সংগঠনের সদস্য উমাশঙ্কর সিংহ জানান, রামেশ্বর লাল যখন ব্যবসা শুরু করেন তখন চারপাশ ছিল মূলত জঙ্গল। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি এলাকার মানুষদেরও তিনি সেখানে ভাড়ায় জমি পাইয়ে দিয়ে লোহার ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করেন। আস্তে আস্তে পূর্বে গিরিশ ঘোষ রোড থেকে পশ্চিমে জিটি রোড পর্যন্ত প্রায় দেড়শো বিঘা জমিতে গড়ে ওঠে বজরংবলী লোহা বাজার। বিশাখাপত্তনম, রৌরকিলা, ভিলাই, বোকারো, গিরিডি, মোগলসরাই, বারাণসী, পটনা, বিহার, জামালপুর সহ বিভিন্ন জায়গার কারখানা থেকে বাতিল লোহার জিনিস আসত এই বাজারে। স্থানীয় অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানও হয়েছিল।
শুধু গুদাম ব্যবসাতেই আটকে থাকেনি বজরংবলী। বহু ব্যবসায়ী ছাঁট লোহা কিনে এনে ভাড়ায় বিভিন্ন গুদামে রাখতে শুরু করেন। যেমন ওই সিলিন্ডারগুলি রাখা হয়েছিল। আবার গুদাম ও ছাঁট লোহার ব্যবসায়ীদের মধ্যে দালালি করেই এক-এক জনের মাসে রোজগার ন্যূনতম ৪০ হাজার টাকা, জানালেন উমাশঙ্করবাবু। তবে ১৯৮০ থেকে বজরংবলীতে রেলের ছাঁট লোহা ঢুকতে শুরু করার পরে তার ভাগ-বাঁটোয়ারা শুরু হয় অশান্তি।
এখন মূল বাজার ছাড়াও আটটি ছোট বাজার রয়েছে। তবে এক সময়ে রমরমিয়ে চলা সেই বজরংবলীতেই এখন ভাটার টান। অন্য রাজ্য থেকে লোহা নিয়ে আসার খরচ বেড়ে যাওয়া, নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কমে যাওয়া তো আছেই। অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসার ধরন বদলে তৈরি করেছেন স্কুল, কলেজ বা অন্য প্রতিষ্ঠান।
তবু এখনও শিবরাত্রির সলতের মতোই জেগে রয়েছে এই লোহা বাজার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy