Advertisement
১১ মে ২০২৪

মলাটেই জিয়নকাঠি, লাইব্রেরি সামলাচ্ছেন বৃদ্ধ বইপোকা

গ্রন্থাগারিক পদটিই নেই সুবর্ণরেখা কলেজে। গ্রন্থাগারিকের জন্য উচ্চশিক্ষা দফতরে বেশ কয়েকবার আবেদন জানিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।

বইয়ের-মাঝে: যতীন্দ্রনাথ বেরা। নিজস্ব চিত্র

বইয়ের-মাঝে: যতীন্দ্রনাথ বেরা। নিজস্ব চিত্র

কিংশুক গুপ্ত
গোপীবল্লভপুর শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৯ ০২:০৫
Share: Save:

শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার। আর সেই মারণ রোগের সঙ্গে লড়েই হাজার হাজার বই সামলাচ্ছেন অশীতিপর যতীন্দ্রনাথ বেরা।

বই-পাতার গন্ধই যেন জীবনীশক্তি ৮৬ বছর বয়স যতীন্দ্রনাথের। গ্রন্থাগারের র‍্যাকে, আলমারিতে কোথায় কোন বই রয়েছে এক নিমেষে বার করে ফেলেন সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়ের এই ‘সিধু জ্যাঠা’। গ্রন্থাগারের ১৭ হাজার ২২২টি বইয়ের দেখভালের মধ্যেই ভাল থাকার রসদ খুঁজে পান কলেজের এই অতিথি গ্রন্থাগারিক।

গ্রন্থাগারিক পদটিই নেই সুবর্ণরেখা কলেজে। গ্রন্থাগারিকের জন্য উচ্চশিক্ষা দফতরে বেশ কয়েকবার আবেদন জানিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অনুমোদন মেলেনি। এই পরিস্থিতিতে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের অনুরোধে গ্রন্থাগারটি চালানোর দায়িত্ব নেন যতীন্দ্রনাথ। এখন সত্যরঞ্জন বারিক নামে আর একজন সহ-অতিথি গ্রন্থাগারিক রয়েছেন। সত্যরঞ্জন আবার টিএমসিপি-র ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি। সত্যরঞ্জন বারিক বলেন, ‘‘এক সময় গ্রন্থাগারিকের অভাবে কলেজের গ্রন্থাগারটি বন্ধ হতে বসেছিল। যতীন্দ্রনাথবাবু যোগ দেওয়ার পরে সেটি চালু হয়। পরে আমি যোগ দিই। ওনার দক্ষতা ও কাজের প্রতি ভালবাসা আমাদেরও অনুপ্রাণিত করে।’’ যতীন্দ্রনাথের প্রথাগত শিক্ষা নেই। তবে সত্যরঞ্জন মাস্টার্স অব লাইব্রেরি সায়েন্স-এর ডিগ্রিপ্রাপ্ত। সত্যরঞ্জন অবশ্য যতীন্দ্রনাথের তুলনায় বেশি সাম্মানিক পান।

যতীন্দ্রনাথের বাড়ি গোপীবল্লভপুরের বর্গিডাঙায়। পড়াশোনা নবম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে ছোট থেকেই বইয়ের প্রতি নিবিড় টান। যুবা বয়সে কলেজ স্ট্রিটে একাধিক প্রকাশকের অধীনে কাজ করেছেন। ১৯৮৮ সালে সুবর্ণরেখা কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যতীন্দ্রনাথ। তখন তিনি গোপীবল্লভপুরের ব্যোমনিলীমা সারস্বত গ্রামীণ পাঠাগারের কর্মী। সেখানে থেকে অবসর নেওয়ার পরে সুবর্ণরেখা কলেজে অতিথি-গ্রন্থাগারিক পদে যোগ দেন তিনি। এই কলেজে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় সতেরশো। গ্রন্থাগার আধুনিকীকরণের কাজ চলছে। বসেছে সিসিটিভি ও কম্পিউটার। তবে যতীন্দ্রনাথ নিজে মোবাইল বা কম্পিউটার কিছুই ব্যবহার করেন না। ১৭,২২২টি বইয়ের স্পাইন লেভেলিং দেখেই মুহূর্তের মধ্যে দেরাজ থেকে বার করে দেন পড়ুয়াদের চাহিদামতো বই।

কলেজ পড়ুয়া তৃণ্ময় বেরা, দীপা মল্লিকদের কথায়, ‘‘উনি কম্পিউটারকেও হার মানিয়ে দেন। গ্রন্থাগারের সব কিছু ওঁর নখদর্পণে।’’ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রতনকুমার সামন্তও বলেন, ‘‘বইগুলিতে বার কোড পদ্ধতি চালুর কাজ চলেছে। তবে যতীন্দ্রনাথবাবু আদ্যন্ত বই-পোকা। বইয়ের প্রতি ভালবাসা তাঁকে সুস্থ রেখেছে।’’

সে কথা মানছেন যতীন্দ্রনাথও। বছর পাঁচেক আগে কোলন-ক্যানসারে আক্রান্ত হন যতীন্দ্রনাথ। তবে মনের জোর হারাননি। বই তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। যতীন্দ্রনাথের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় ও ছোট ছেলে ব্যবসা করেন। মেজ ছেলে মেদিন‌ীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের কর্মী। চেন্নাইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোচারের পরে মাস তিনেক বাড়িতে বিশ্রামে থাকতে হয়েছিল যতীন্দ্রনাথকে। ওই সময় বাড়িতেই বই আর খবরের কাগজে চোখ বোলাতেন। এখনও নির্দিষ্ট সময় অন্তর চেক-আপ করাতে যেতে হয়। তবে ছুটির দিন বাদে বেশিরভাগ সময় তিনি কাটান কলেজের গ্রন্থাগারেই। সময় পেলেই বই অথবা জার্নাল টেনে নিয়ে পড়তে বসেন তিনি। তা সে ভূগোল হোক, ইতিহাস কিংবা পুষ্টিবিজ্ঞান।

দুই মলাটেই যে তাঁর জিয়নকাঠি বন্দি তা মানছেন বইপোকা বৃদ্ধ। একগাল হেসে বলছেন, ‘‘প্রথাগত শিক্ষিত হতে পারিনি। কিন্তু বইয়ের মাঝে থেকে এখনও শিখে চলেছি। এটাই আমার নেশা।’’ যতীন্দ্রনাথের স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মী চয়নিকাও মানছেন, ‘‘বইয়ের জগতে উনি ভাল থাকেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Cancer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE