Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শপিং মলেও পাটের পচা গন্ধ

অমরের নাতি রুদ্র এ বার কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটি ঢুকেছেন। বেশ অবাক হয়ে তিনি দাদুকে জিজ্ঞাসা করেন,  ‘এত কিছু থাকতে নয়ানজুলি কেন?’

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

গৌরব বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:২৩
Share: Save:

‘ঘোর কলি হে, ঘোর কলি!’

দিনে অন্তত বার পঞ্চাশেক কথাটা বলেন অমর ঘোষ। তাঁর বয়স হয়েছে ঢের। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসে—‘তা চার কুড়ি হয়েছে অনেক দিন হল।’ বাড়ির লোকজন অমরের কিছু কিছু আবদারে বেশ বিরক্ত হন। এই ক’দিন ধরে ‘বুড়ো’ যেমন বায়না ধরেছেন, ‘আমাকে এক বার নয়ানজুলির ধারে নিয়ে চল।’ সে কথা অবশ্য কানে তোলেননি বাড়ির লোকজন। পুজোর ছুটিতে আসা হবে না বলে বৃদ্ধের মেয়ে কলকাতা থেকে দিন দুয়েকের জন্য মুর্শিদাবাদে বাপের বাড়িতে এসেছেন। বাবাকে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি দিয়ে মেয়ে বলেন, ‘তোমার নাতিকে বলো। ও তোমাকে নিয়ে যাবে।’

অমরের নাতি রুদ্র এ বার কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটি ঢুকেছেন। বেশ অবাক হয়ে তিনি দাদুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এত কিছু থাকতে নয়ানজুলি কেন?’ নাতির কথা শুনে রেগে ওঠেন বৃদ্ধ, ‘আহাম্মকের মতো প্রশ্ন করিস না। নয়ানজুলির ধারে না গেলে বুঝব কী করে, পুজো আসছে। বাইরে ঝলমল করবে রোদ্দুর। মাথার উপরে ঝকঝকে শরতের আকাশ। আর পাট পচার গন্ধ। আহা...’

শহুরে যুবক রুদ্র ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘সত্যি দাদু, বাড়ির লোকজন ঠিকই বলে। তোমার মাথাটা এক্কেবারে গিয়েছে। পচা গন্ধ কারও ভাল লাগে? আর এই পুজোর সময় তুমি সেই পচা গন্ধ শুঁকবে বলে বাড়ি মাথায় করছ?’ এ বারে বৃদ্ধ ম্লান হাসেন। নাতিকে সস্নেহে কাছে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘ঘোর কলি রে দাদুভাই, ঘোর কলি। শোন, গাঁয়ে পুজো আসে অন্য ভাবে। নয়ানজুলির দু’ধারে মাথা দোলায় কাশফুল। জলে জাঁক দেওয়া হয় পাট। সেই পাট পচার গন্ধ শুঁকেই চাষি বুঝতে পারে, দুয়ারে পুজো।’

রুদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধের মুখের দিকে। বৃদ্ধের কথা শুনতে শুনতে তাঁর মনের অনেকগুলো বন্ধ দরজা খুলে যেতে থাকে। বৃদ্ধ বলে চলেন, ‘এই পাটকে ঘিরেই তো সব রে দাদুভাই। পাটের দাম ভাল পেলে তবেই না চাষি পুজোর বাজার করবে। শুধু কি তাই, এই পাটের টাকাতেই তো তোর মায়ের বিয়ে দিয়েছি রে। এখন সব বদলে যাচ্ছে। পাটের দাম নেই। এক বিঘেতে খরচ ১৮ হাজার টাকা। সেই পাট বিক্রি করে ঘরে উঠছে তেরো থেকে চোদ্দো হাজার টাকা।’ বৃদ্ধের ইচ্ছেপূরণ করেছিলেন রুদ্র। বিকেলে অমরকে নিয়ে গিয়েছিলেন নয়ানজুলির ধারে। বৃদ্ধ প্রথমে শিশুদের মতো খুশি হলেন। ফেরার পথে ধুতির খুঁটে চোখ মুছলেন।

মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে শহরের একটি শপিং মলে ঢুকলেন রুদ্র। বিল মেটানোর সময় কাউন্টারের ছেলেটি জানতে চাইলেন, ‘স্যর, ব্যাগ দেব? আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করেছি। এখন সব জুট-ব্যাগ।’ শহুরে শপিং-মলে নানাবিধ পারফিউমের গন্ধ ঢাকা পড়ে রুদ্রের নাকে ধাক্কা দেয় নয়ানজুলির সেই পাটপচা গন্ধ। রুদ্রের চোখ দু’টো কি ছলছল করছে? বাইরে এক্কাদোক্কা খেলছে শরতের রোদ্দুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE