Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

ঢুকছে বাড়ি ফেরার স্রোত, চলছে লড়াই

জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রথম থেকেই আশাকর্মীরা বহিরাগতদের চিহ্নিত করে ব্লক অফিসে খবর দিচ্ছিলেন।

সোমবারও বাসে-ভ্যানে দলে-দলে জেলায় ফিরলেন ভিন্‌ রাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকেরা। কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

সোমবারও বাসে-ভ্যানে দলে-দলে জেলায় ফিরলেন ভিন্‌ রাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকেরা। কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২০ ০৬:০২
Share: Save:

শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে লম্বা লাইন। সেই লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বছর চল্লিশের এক জন মেঝের উপরেই শুয়ে পড়লেন। শরীর আর নিচ্ছে না। খাওয়া নেই, জল নেই। ফিরেছেন চেন্নাই থেকে। আরও বহু জনের মতো উঠেছিলেন কলকাতা থেকে করিমপুরের সরকারি বাসে তিনি। কৃষ্ণনগরে ঢোকার মুখে সেই বাস আটকে দিয়েছে পুলিশ। যাত্রীদের নাম-ঠিকানা নথিভুক্ত করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। সেখানে তৈরি করা হয়েছে কোয়রান্টিন কেন্দ্র। রবিবার রাতে এমন আরও একটি করিমপুর যাওয়ার সরকারি বাস আটকে যাত্রীদের শক্তিনগরে পাঠানো হয়েছে। সেটিতে যাত্রীর সংখ্যা প্রায় একশো।

রবিবার থেকেই বাইরের রাজ্য থেকে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে নদিয়ায়। ট্রেন বন্ধ থাকলেও সোমবারও কৃষ্ণনগরে ঢুকতে দেখা গিয়েছে বহু মানুষকে। কেউ দূরপাল্লার বাসে এসেছেন তো কাউকে কলকাতার ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখা গিয়েছে। কল্যাণী, রানাঘাট, তেহট্টেও দেখা গিয়েছে এই দৃশ্য। এই বিরাট সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকদের চিহ্নিত করতে কার্যত হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে। সোমবার বিকেলে ভিড়ে ঠাসা অন্তত আরও তিনটি বাস ধর্মতলা থেকে রওনা দিয়েছে।

জেলা প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, রবিবার রাত পর্যন্ত এমন যত বাস জেলায় ঢুকেছে সেগুলির সব ক’টিকে আটকে যাত্রীদের পরীক্ষা করে কোয়রান্টিন সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও যে বিরাট সংখ্যক মানুষ কোনও রকম ‘স্ক্রিনিং’ ছাড়াই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে, তা স্বীকার করে নিচ্ছে জেলা প্রশাসনের কর্তা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্তারা। এঁদের চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ও হোম কোয়রান্টিনে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করাই প্রশাসনের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তা করতে পারলে এঁদের ২৪ ঘণ্টা নজরে রাখা যাবে। যাঁদের মধ্যে কোনও রকম অসুস্থতার লক্ষণ পাওয়া যাবে না, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

এর বাইরেও, শনিবার সকালেই পুলিশ কয়েক জনকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে পাঠিয়েছে। ‘স্ক্রিনিং’ করা হয়েছে এঁদের। লিখে রাখা হচ্ছে নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর। তাঁরা সব নিয়ম মেনে চলবেন, এমনটা ফর্মে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বিরাট সংখ্যক মানুষের চাপ নিতে পারছে না জেলা হাসপাতাল। শুধু পানীয় জল সরবরাহ করতে গিয়েই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ক্ষোভ বাড়ছে কোয়রান্টিনে থাকা লোকজনের।

জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রথম থেকেই আশাকর্মীরা বহিরাগতদের চিহ্নিত করে ব্লক অফিসে খবর দিচ্ছিলেন। রবিবার থেকে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আইসিডিএস কর্মী ও এএনএম-দের। তাঁদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যেরা। তাঁরা বাইরে থেকে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করে ব্লকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সেই সঙ্গেই তাঁদের স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দেখিয়ে আসতে বাধ্য করছেন। ফর্ম পূরণ করিয়ে এঁদের ১৪ দিন হোম কোয়রান্টিনে থাকার মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর অন্যথা করলে আইনানুগ পদক্ষেপের কথাও লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

সামাজিক নজরদারি যাতে চালানো যায়, তার জন্য বিভিন্ন ব্লক অফিস থেকে গ্রামে-গ্রামে মাইকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই গ্রামে কাকে-কাকে হোম কোয়রান্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। হোম কোয়রান্টিনে থাকা লোকেদের বাড়ির দেওয়ালে নোটিসও টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য, গ্রামের মানুষ যাতে তাঁদের উপরে নজরদারি করেন এবং তার জেরে তাঁরা চাইলেও বাড়ি থেকে বেরোতে না পারেন।

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এখন সামাজিক সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। আমরা সেই কাজটাই করার চেষ্টা করছি। যেমন করেই হোক আমাদের হোম কোয়রান্টিনে থাকা লোকজনের বাইরে বার না-হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।” আশা, আইসিডিএস এবং এএনএম কর্মীরা বহিরাগতদের পরিবারের লোকজনকে বোঝাচ্ছেনও।

তবে আতঙ্ক এতটাই জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে যে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বহিরাগতদের গ্রামে ঢুকতে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি তোলা হচ্ছে। এই নিয়ে বিবাদও হচ্ছে। শুধু নবদ্বীপ ব্লকেই এমন চারটি ঘটনা ঘটেছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। শেষে স্বাস্থ্যকর্মীরা গিয়ে বহিরাগত ব্যক্তি সুস্থ বলে জানালে বা হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করিয়ে ফিরলে, তবেই গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতি রানাঘাট থেকে কালীগঞ্জ, কৃষ্ণনগর থেকে করিমপুর সর্বত্র।

এ দিন করিমপুর-কৃষ্ণনগর রুটে কোনও বাস না চলায় ভিন্ রাজ্য থেকে আসা অনেকে ট্রাক বা ছোট গাড়িতে করিমপুরে ফেরেন। মূলত এঁদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও সচেতন করার জন্য করিমপুর পুরনো বাসস্ট্যান্ডে শিবির করা হয়েছিল। সকাল থেকে সেখানে হাজির ছিলেন আশাকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁরা বহিরাগতদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেন। কারও উপসর্গ থাকলে করিমপুর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের নিজের বাড়িতে হোম কোয়রান্টিনে থাকতে বলা হয়েছে । করিমপুর হাসপাতালে সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন জরুরি বিভাগে রোগীদের লম্বা লাইন ছিল। এঁদের মধ্যে ভিন্ রাজ্য থেকে আসা লোকজনের সঙ্গে স্থানীয়েরাও ছিলেন, যাঁরা জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছেন।

চাপড়া ব্লকে বাইরে থেকে ফেরা ১০৩১ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে ৭৩২ জন সোমবারই চাপড়া গ্রামীণ হাসপাতালে এসে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়েছেন। সাতসকাল থেকেই সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের লম্বা লাইন দেখা গিয়েছে। তৃণমূলের চাপড়া ব্লক সভাপতি তথা জেলা পরিষদ সদস্য জেবের শেখের দাবি, ‘‘বাইরে থেকে যারা ফিরেছে, তাদের প্রায় সকলকেই চিহ্নিত করে হাসপাতালে পাঠাতে পারছি। তা সম্ভব হচ্ছে, কারণ রবিবার রাতেই আমরা সমস্ত পঞ্চায়েত সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলাম যে তাঁরা যেন এই কাজটা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে করেন।”

নদিয়া জেলাশাসক বিভু গোয়েল বলেন, “সমস্ত রকম ভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে বাইরে থেকে ফেরা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাঁদের হোম কোয়রান্টিনে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Migrating Labour Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE