আর লাঠিখেলা দেখাতে পারবেন না ফকির শেখ
মহরমে লাঠি খেলা চলছে।
দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে ঠকাঠক... ঠকাঠক। ছোট্ট মাঠটায় থিকথিক করছে ভিড়। কিন্তু লোকজন উসখুস করছে। খেলাটা যেন ঠিক জমছে না।
জমবে কী করে? এখনও যে ফকিরই আসেননি। তিনিই তো খেলোয়াড়দের মধ্যমণি!
অবশেষে ঢুকলেন বছর তিরিশের ফকির। পরনে আঁটোসাঁটো পোশাক। পেটানো চেহারা। সবার নজর তাঁর দিকে। এ বার শুরু হবে ম্যাজিক।
ম্যাজিকই বটে! সকলের হাতে ছিপছিপে লাঠি। ভরাট গলায় ফকির হাঁক দিলেন, ‘‘কই রে, আমার লাঠিটা দে।’’ সাগরেদরা ছুটে এসে তাঁর হাতে তুলে দিলেন ইয়া মোটা বাঁশ। সেটা দিয়েই ভেলকি দেখাতে শুরু করলেন ফকির। দু’হাতে ধরা বাঁশ। আর পিঠের পিঠের উপর ঘুরছে ঢেঁকি! লোকজন মন্ত্রমুগ্ধের তাকিয়ে আছেন সে দিকে।
ফকির শেখ। সাকিন বেলডাঙা ২ ব্লকের শক্তিপুর। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে গঙ্গা। সেই গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে ফকির শেখ কত দিন কেঁদে ফেলেছেন! সে কথা জানে হার না মানা ঢেউ। আর নোনতা বিকেল। সবাই তাঁকে ‘সাবাশ...সাবাশ’ বললেও ফকির জানতেন, সেরাটা তিনি
দিতে পারেননি।
মহরম মানে আমজনতার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, শোক, তাজিয়া, জারিগান এবং লাঠিখেলা। ফকির শুধু একটাই স্বপ্ন দেখতেন, লাঠিখেলায় তাঁকে সেরাটা দিতে হবে। সেটা না হলেই তাঁর মনখারাপ হয়ে যেত। বছরভর ফকির চাষআবাদ নিয়েই থাকতেন। মহরমের আগের কয়েক মাস থেকে খেত থেকে ফিরে বাড়ির পাশের ফাঁকা মাঠে শুরু হত মহড়া। তা দেখতেও দাঁড়িয়ে পড়তেন পথচলতি লোকজন। ঋতু বদলায়। মহরম আসে। চলে যায়। বয়স বাড়ে ফকিরের।
ফকির সবচেয়ে ভালবাসে তাঁর নাতি আরবাজ শেখকে। নবাবের জেলায় জন্মালেও এখন আরবাজ শহরে থাকে। আরবাজের বয়স এখন তিরিশ। ফকিরের ৮৩। ফকির আক্ষেপ করে বলতেন, ‘‘কোন কোন গাঁ থেকে ছেলেপুলেরা এসে লাঠিখেলা শিখে গেল। আর তোরা কেউ জীবনে লাঠিই ধরলি না!’’ তার পরে ফিসফিস করে বলতেন, ‘‘শোন ভাই, আমার লাঠিটা তুই রেখে দিস। আমাকে মনে পড়লেই লাঠিটা চেপে ধরবি। জানবি, ওটাই আমার জান।’’
শহর থেকে আরবাজ বাড়ি ফিরলেই চনমনে হয়ে উঠতেন ফকির। এই বুড়ো বয়সেও নাতির সঙ্গে মাঝে মাঝে গিয়ে বসতেন গঙ্গার ধারে। আরবাজকে দেখলেই ফকিরের মনে পড়ে যেত তার পুরনো দিনের কথা। ফকির অনর্গল বলে যেতেন। চুপ করে শুনত আরবাজ।
ফকিরের শরীরটা বেশ কিছু দিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। শরীরের কলকব্জা ঢিলে হয়ে গিয়েছে। তিনি শয্যাশায়ী। চারপাশটা ভাল করে তাঁর ঠাওর হয় না। অথচ চোখ বন্ধ করলেই তিনি দেখতে পান, গনগনে সূর্য। তরতাজা দিন। সুঠাম পেশি। আর অনেক অনেক জীবনীশক্তি। ছায়াছবির মতো ভেসে ওঠে সে সব দিন। সেই উল্লাস। সেই পাগলামি। লোকজন চারপাশ থেকে বলছে, ‘সাবাশ ফকির, সাবাশ!’
সাবাশ শব্দটা এই মুহূর্তে যেন ফকিরের কানে আবছা শোনাল। যেন দূর থেকে কেউ তাঁর নাম ধরে ডাকছে। ফ...কি...র...। ফকির কি কিছু বুঝতে পারছেন? ফকিরের পায়ে সাড় নেই। হাত নড়াতে পারছেন না। ডাক্তার জবাব দিয়েছেন। কিন্তু ফকির যেতে চান না। চারপাশে বড্ড মায়া। চারপাশে বড় সুখ সুখ গন্ধ।
শ্রাবণবেলা! দূরে কোথাও রেডিয়োতে বেজে চলেছে ‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা/ হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা...।’ ফকিরের ছোট্ট বাড়িতে বেশ ভিড়। তাঁকে ঘিরে রেখেছে সবাই। ফকির শুয়ে আছেন। ধবধবে বিছানা। সাদা চাদর। আগের দিন বিকেলেও তিনি বেদানার রস খেয়েছেন। আজ তিনি জল খাচ্ছেন।
ভুল হল। তাঁকে খাওয়ানো হচ্ছে। ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। বিছানা ভিজে গেল। ফকিরের চোখ দু’টো কি জ্বালা করল? নানার খবর শুনে ছুটে এসেছে আরবাজ। সে এই ফকিরকে চেনে না। সে ভাবছে, এখনই বুঝি একটা মির্যাকল ঘটবে। এই বুঝি ধড়মড়িয়ে উঠে বসবে লোকটা। তার পরেই হাঁক দেবে, ‘‘কই রে, চল ধানের খেতটা দেখে আসি। তার পরে গিয়ে বসব গঙ্গার পাড়ে।’’ হাত দু’টো কি ঈষৎ কেঁপে উঠল? ঠোঁট দু’টো কি বলে উঠল, ‘‘ওরে কে আছিস, আমার লাঠিটা নিয়ে আয়।’’
হাত দু’টো এক বার উপরে উঠে ধপাস করে পড়ল। কারও হাত এত ঠান্ডা হতে পারে! আরবাজ থই পাচ্ছে না। তাকে আশ্চর্য জাদুবলে নিটোল আঁধারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নবাবের জেলার ফকির! আত্মীয়েরা কেউ ডুকরে উঠছেন। কেউ ঘড়ি দেখছেন বার বার। এখনই ফজরের আজান শুরু হবে। এ বার কেঁপে উঠল ফকিরের পা। আরবাজের গলায় নোনতা ডেলা। তার চোখ জ্বালা করছে। চারপাশে আরও ঘন হয়ে আসছে মেঘ। ফকিরের মাথার কাছেও কি ধোঁয়ার মতো কিছু উড়ছে? আরবাজ শক্ত হতে চায়। পারে না। তার শুধু কান্না পায়। এক বার অস্ফূটে শুধু বলল, ‘নানা...!’ আচমকা ফকিরের বুকের ধুকপুকুনিটা বেড়ে গেল। তার পরে চুপ। এ বার কণ্ঠনালীটা বার দু’য়েক কেঁপে উঠল। তার পরে তা-ও স্থির। সব ঠান্ডা। ঘন শ্রাবণেও যেন বাইরে হিম পড়ছে। ফকির চলে যাচ্ছেন। পিছনে পড়ে রইল গঙ্গাপাড়, লাঠিখেলা, পরিজন আর প্রিয় নাতি! গোরস্থানে মাটি দেওয়ার সময় ভেজা বাতাস যেন আরবাজের কানে কানে বলল, ‘‘মায়াগুলোকে আঁকড়ে থাকিস ভাই। লাঠিটাকে যত্ন করিস।’’
মহরমের আর দেরি নেই। মাইকে বাজবে কারবালার গান। লাঠিতে লাঠিতে আওয়াজ হবে— ঠকাঠক, ঠকাঠক। সব থাকবে। সবাই থাকবে। শুধু ফকির আর কোনও দিন বলবেন না, ‘‘কই রে, আমার লাঠিটা....।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy