Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
International Mother Language Day 2020

স্মৃতিতে ভাষা আন্দোলন

এই ঘটনার খবর চুয়াডাঙার নীলমণিগঞ্জে পৌঁছয় শেষ বিকেলে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে দিন সন্ধ্যায় নীলমণিগঞ্জের পরিমল বসুর বাড়িতে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হল। পরিমল বসু ছাড়াও সেখানে ছিলেন তারাপদ মৈত্র, হাবু ঘোষ, জব্বার খান, আতিয়ার রহমান প্রমুখ।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৩:৪১
Share: Save:

ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর খবরটা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। দিনটা ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮)। সে দিন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে বহু মানুষ সরকারি আদেশ অমান্য করে এক বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করেন। মিছিল যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছে, তখন পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। নিহত রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার-সহ অনেকের রক্তে লাল হয়ে যায় রাজপথ।

এই ঘটনার খবর চুয়াডাঙার নীলমণিগঞ্জে পৌঁছয় শেষ বিকেলে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে দিন সন্ধ্যায় নীলমণিগঞ্জের পরিমল বসুর বাড়িতে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হল। পরিমল বসু ছাড়াও সেখানে ছিলেন তারাপদ মৈত্র, হাবু ঘোষ, জব্বার খান, আতিয়ার রহমান প্রমুখ। সভাশেষে এক মিছিল নীলমণিগঞ্জ পরিক্রমা করল। এই খবর কয়েক মাইল দূরের চুয়াডাঙা থানার পুলিশকর্তাদের কানে যেতে খুব বেশি দেরি হয়নি। রাত গভীর হতেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি চলল পুলিশের হানা। পরিমল গ্রেফতার হলেন। অন্যেরা আত্মগোপন করলেন। পর দিন এই খবর ছড়িয়ে পড়লে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঢেউয়ে তোলপাড় হল চুয়াডাঙা। ২৩ ফেব্রুয়ারি স্কুলমাঠের সভায় পরিমল বসুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি উঠল। বক্তৃতা করলেন ওহিদ হোসেন, রহমতুল্লাহ, মজিবুর রহমান, তারাপদ মৈত্র প্রমুখ। তৈরি হল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। চুয়াডাঙা জুড়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হল।

সাড়া পড়ল দারুণ! সব স্কুল বন্ধ করে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকলে মিলে বিশাল মিছিল শেষ হল আলি হোসেনের আমবাগানে। সেখানে সভা চলাকালীন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেন তারাপদ মৈত্র। এর পর বহু বার তিনি পুলিশের কাছে হেনস্থা হয়েছেন। দু’বার গিয়েছেন জেলে।

বাবার কাছে শোনা এ সব ঘটনা একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই মনে পড়ে যায় তারাপদবাবুর ছেলে, প্রাবন্ধিক স্বপন মৈত্রের। ভাষা আন্দোলনের বছরেই জন্ম স্বপনের। তাঁর কথায়, “আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়েশুধুই ভাষা আন্দোলন। ভাষাশহিদেরা ছিলেন ছোটবেলার আসল নায়ক। আমার বাবা ভাষা আন্দোলনের জন্য জেল খেটেছেন ভাবলে তখনও যেমন রোমাঞ্চ হত, এখনও তেমনই হয়।”

স্বপনবাবু ১৯৬৪ সালে শান্তিপুরে চলে আসেন পড়াশোনার জন্য। তারাপদবাবু আসেন আরও পরে, ১৯৬৮ সালে। চাপড়ায় বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন। প্রতি বছর ২১ তারিখে পাড়ার ছেলেপুলেদের ডেকে খাওয়াতেন। স্বপনবাবুর কথায়, “আমার মা ছিলেন খুব উৎসাহী। তাঁরই আগ্রহে আমাদের বাড়িতে একুশে পালন হত।”

তবে একুশে গুলি চলার খবর ঢাকা থেকে যশোর জেলা নড়াইল থানার রঘুনাথপুরে পৌঁছতে অবশ্য একটা দিন সময় নিয়েছিল। সেখানে খবর পৌঁছয় পরের দিন। আবদুল খালেক ছিলেন রঘুনাথপুরের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। পরবর্তী সময়ে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হন। তাঁর কাছেই এই খবর পান এগারো বছরের কিশোর সুনীল বসু। বড়দের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। তার পর একই ভাবে মিটিং-মিছিল, প্রতিবাদ। শিশু থেকেই গলার জোর বেশি ছিল। তাই ভাষা আন্দোলনের মিছিলে সবার আগে থাকতেন তিনি। গান-কবিতা-স্লোগানে তিনিই ছিলেন প্রধান কণ্ঠ।

বিষয়টা নজরে পড়েছিল বিরোধীদের। আন্দোলন যখন উদ্দাম গতিতে চলছে এ সময়ে এক দিন কিশোর সুনীলকে ঘিরে ধরল এক দল মানুষ। হাতে উদ্যত বন্দুক। কী ভাবে সে দিন রক্ষা পেয়েছিলেন, এখনও একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই সে কথা মনে পড়ে যায় আশি বছরের সুনীলকুমার বসুর। নদিয়ার এই প্রবীণ মানুষটি চল্লিশ বছর ধরে একই ভাবে একুশে পালন করে আসছেন। তাঁর কথায় “জীবনে অনেক ঘাতপ্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?”

একুশের অমলিন স্মৃতি নিয়েই আজ গোটা দিন কাটবে স্বপন মৈত্র, সুনীল বসুদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE