সরকারি হাসপাতালে সব পরিষেবাই বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা। এমআরআই, সিটি স্ক্যান, ডিজিট্যাল এক্স-রে করানো থেকে পেসমেকার বসানো— রোগীর কোনও টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়। রক্তের যাবতীয় পরীক্ষাও বিনামূল্যে হওয়ার কথা।
কিন্তু কল্যাণীর গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জনা কয়েক টেকনিশিয়ান। পরিচয় জানতে চাইলে অবলীলায় বলছেন তাঁরা ‘হাসপাতালের কর্মী’। খোঁজ নিচ্ছেন, চিকিৎসক কোন-কোন রোগীকে কী-কী রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেছেন। বাতলে দিচ্ছেন, কম খরচে ‘সেরা পরীক্ষা’ কোথা থেকে করানো যাবে। যে পরীক্ষা বিনামূল্যে হওয়ার কথা, টাকা খরচ করে তা করাচ্ছেন রোগী ও তাঁর আত্মীয়স্বজন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর কয়েক আগে সেখানে সরকারি-বেসকারি উদ্যোগে (পিপিপি মডেল) ডায়াগনিস্টিক কেন্দ্র চালু হয়েছিল। হাসপাতালেরই এক কর্তার দাবি, কেন্দ্রটির সঙ্গে স্বাস্থ্যভবনের হওয়া চুক্তির মেয়াদ ইতিমধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। তার পরেও কেন্দ্রটি চলছে। টেকনিশিয়ানেরা ওই কেন্দ্রেরই লোক বলে অভিযোগ।
এমনিতে গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালে মোটামুটি রক্তের সব পরীক্ষাই হয়। সবই হয় বিনামূল্যে। যে পরীক্ষাগুলো হয় না, সেগুলো অনায়াসেই জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল হাসপাতালে করানো যায়। অর্থাৎ, রক্ত পরীক্ষার জন্য রোগীর কোনও টাকা খরচ হওয়ারই কথা নয়। ওই ডায়গনস্টিক সেন্টারের টেকনিশিয়ানদের সৌজন্যে তা হচ্ছে না। রোগীর আত্মীয়দের অভিযোগ, নিজেদের ‘হাসপাতালের কর্মী’ বলে পরিচয় দিয়ে তাঁরা বোঝাচ্ছেন, টাকা খরচ না করলে ঠিকঠাক রক্ত পরীক্ষা সম্ভব নয়। রোগীর আত্মীয়েরা সেই কথায় বিশ্বাস করছেন এবং টাকা দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করাচ্ছেন। এমনকি ওই টেকনিশিয়ানরা সরাসরি ওয়ার্ডে ঢুকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করছেন বলে অভিযোগ। দিন কয়েক আগে ধুবুলিয়ার এক রোগিণী এমন ভাবেই প্রতারিত হন। হাসাপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে চিকিৎসকেরা তাঁকে বেশ কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেন। তাঁর অভিযোগ, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকজনের খপ্পরে পড়ে তিনি টাকা খরচ করে রক্তপরীক্ষা করান। পরে জানতে পারেন, সব ক’টি পরীক্ষাই হাসপাতালে বিনামূল্যে করা যেত। রোগিণীর আক্ষেপ, ‘‘আমাদের মতো গরিব মানুষের কাছে ওই টাকাগুলো অনেক। কিন্তু ওদের খপ্পরে পড়ে টাকাগুলো বেরিয়ে গেল।’’
হাসপাতাল কর্মীদেরই একাংশের দাবি, এক সময়ে বাইরের লোকজন সেখানে ঢোকার সাহস পেতেন না। এখন দিব্যি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢুকে রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালে হৃদ্রোগের চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও ইকোকার্ডিওগ্রাম করার পরিকাঠামো নেই। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকজন ওয়ার্ডে ঢুকছেন বলে অভিযোগ।
মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের যুবক সামিরুল শেখ তাঁর দিদিকে নিয়ে এসেছিলেন হাসপাতালে। তাঁর অভিযোগ, ডাক্তার ইকোকার্ডিওগ্রাম করাতে বলেছিলেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকজন জানান, ওই পরীক্ষা করতে ১১৫০ টাকা লাগবে। সে দিনই পরীক্ষা করাতে চাইলে ১০০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। তিনি সেই বাড়তি টাকা দিয়েই দিদির পরীক্ষা করিয়েছেন।
হাসপাতালের ঢিলেঢালা অবস্থা নিয়ে সরব হয়েছেন অনেকেই। হাসপাতালের প্রাক্তন সুপার সুবিকাশ বিশ্বাস বলছেন, ‘‘এক সময়ে ইকোকার্ডিওগ্রাম পরীক্ষার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য স্বাস্থ্য ভবনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তার পর তো আমি দায়িত্ব থেকে সরে গিয়েছি।’’
ডায়গনস্টিক সেন্টারের কর্মীরা কেন ওয়ার্ডে ঢুকছেন?
ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার যিনি দেখভাল করেন, সেই সুভাষ বিশ্বাসের দাবি, ‘‘আমাদের কর্মীরা হাসপাতালের ভিতরে যান, কারণ আমাদের সঙ্গে সরকারের ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে। সরকারের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়নি। সেই পরীক্ষাগুলিই করা হয়, যেগুলি হাসপাতালে হয় না। তবে বাইরের বহু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকও ওয়ার্ডে যায়।’’ তবে চুক্তি সংক্রান্ত কোনও কাগজপত্র তিনি দেখাতে পারেননি।হাসপাতাল সুপার নিলয় সিংহ বলেন, ‘‘ওই ডায়গনস্টিক সেন্টারের লোকজন ওয়ার্ডে ঢুকছেন, এমন কোনও অভিযোগ আমি পাইনি।’’ চুক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে কি না, তা-ও তিনি জানাতে পারেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy